শাহরিয়ার সোহাগ এর "প্রাক্তন"। পর্ব - ২৭
শাহরিয়ার সোহাগ এর "প্রাক্তন"। পর্ব - ২৭
থার্ড ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষার পর ওদের
তখন ভার্সিটি বন্ধ ছিল। সাফায়েতের এক বন্ধু ছিল রাসেল। খুব কাছের বন্ধু না, একসাথে
এক ডিপার্টমেন্টে পড়াশোনা করে মোটামুটি সম্পর্কের ফ্রেন্ড বলা যায়। রাসেল ওর বড়
ভাইয়ের বিয়ের ফটোগ্রাফির জন্য বিপ্লবকে বলেছিলো। আর বিপ্লবের লেজ হয়ে সেই প্রোগ্রামে
গিয়েছিল সাফায়েত। রাসেলের বাড়ি টাঙ্গাইলে। রথ দেখা আর কলা বেঁচা প্রবাদের মত একটু
ঘোরাঘুরি আর ফটোগ্রাফি দুইটা কাজই হবে ওদের, এজন্য দুই দিনের বিয়ের প্রোগ্রামে ছবি
তোলার জন্য সাফায়েত আর বিপ্লব রাজি হয়েছিল। রাসেলের বাবা রাজনীতি করেন। তবে এখন দল
ক্ষমতায় নেই। অপজিশন পার্টি হয়েও বেশ প্রভাবশালী তিনি। এলাকাতে সম্মান, নামডাক, প্রভাব,
ক্ষমতা সবই আছে। সরকারদল কিংবা বিরোধীদল সবাই এক নামে তার বাবাকে চেনে, সম্মান করে।
অত্র এলাকাতে রাসেলদের বাড়িটা নেতার বাড়ি নামেই পরিচিত। রাজনীতিবিদ হওয়াতে সব শ্রেণী-পেশার
মানুষের সাথেই উনার উঠাবসা, খুব দারুণ সখ্যতা। এখনকার উঠতি হাইব্রীড রাজনীতিবিদদের
মতো তিনি নন। মানুষের সাথে মেশেন, দান করেন একদম মন থেকে। লোক দেখানো ব্যাপারটা তাঁর
মধ্যে নেই বললেই চলে। তাঁর রাজনীতির শুরু ছাত্রজীবনে। কাদের সিদ্দিকীকে তিনি রাজনৈতিক
গুরু মানেন। তাঁর স্মৃতিচারণের অনেকটাই এই বঙ্গবীর। থাকবেই বা না কেন, রাজনীতির হাতে
খড়ি তো তার হাত ধরেই। রাসেলের আচরণে এতদিনের ভার্সিটি জীবনে কখনো মনে হয়নি রাসেলের
পারিবারিক অবস্থা এমন হতে পারে। এতদিনে রাসেলের চলাফেরার সাথে তার এই পারিবারিক অবস্থা
দেখে কিছুতেই মেলাতে পারছিল না বিপ্লব আর সাফায়েত। এমনকি বিয়েতে ছবি তোলার দেন-দরবারের
সময় রাসেলের আলু পটল কেনার মত দামাদামির সাথে স্বচক্ষে দেখা রাসেলের ভাইয়ের বিয়ের
এত বড় আয়োজন কোনোভাবেই যাচ্ছে না। হাজার দুয়েক মানুষের আয়োজন। এলাকার সর্বোচ্চ
জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে ভ্যানচালক কেউ বাদ যায় নি অত্র এলাকার নেতার ছেলের বিয়ের
আমন্ত্রণ থেকে। সেই তুলনায় বিয়েতে ছবি তোলার পারিশ্রমিক হাস্যকর বটে। যদিও বিপ্লব
আর সাফায়েত দুজনই এখন মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। রাসেলের সাথে চুক্তি হিসেবে তাদের
দুজনের দুদিনের থাকা এবং খাওয়ার সমস্ত খরচ বহন করার কথা রাসেলের। তেমনটাই হওয়ার কথা
ছিল। কিন্তু হয়নি। রাসেলের মা একটু কিপটা কিসিমের। একটু না, অনেক বেশিই কিপ্টা কিসিমের। কিছু কিছু
সময় উনি খুব দানশীল হয়ে যান। এই যেমন যখন খাবার নষ্ট হয়ে যায় তখন। ভালো খাবার উনি
সব ফ্রিজে ঢুকান। তবে খাবার নষ্ট হয়ে গেলে ডেকে ডেকে জোর করে পাশে বসিয়ে খাওয়ান।
বাড়িতে আংকেল আন্টি ছাড়া কেউ থাকে না। রাসলের বাসাতে যাওয়ার দিন সকালে তাদেরকে দেওয়া
হয়েছিল ফ্রিজে রেখে পঁচানো মাংস। শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মত মশলা দিয়ে পঁচা মাংসের অস্তিত্ব
লুকানোর চেষ্টা করেছিলেন ভদ্রমহিলা। সাফায়েতরা প্রথমে অনিচ্ছাকৃত ভুল ভেবে বমি করেছিল।
পরে জানতে পেরেছিল ওর মায়ের আচোরণটাই এমন। দুয়ে দুয়ে চার মেলানোর কারণ হল রাসেল ওর
বন্ধুদের সাথে খেতে বসতে চাইলেও ওর মা ওকে দোতলাতে আলাদা খেতে দিয়েছিল। বিপ্লব আর সাফায়েতের
চোখে রাসেলের বাবা এবং মা দুজন হলো দুই মেরুর বাসিন্দা। সাফায়েতরা রাসেলের বন্ধু সেটা
আন্টি জানেন। রাসেলদের দোতলা ডুপ্লেক্স বাড়ি। বাড়ির পেছনে ওদের একটা পুরনো বাড়ি
আছে। আগে ওটাতেই থাকতো। সাফায়েতদের থাকার ব্যবস্থা করা হলো সেই পুরনো বাড়িতে। তবে
রাসেলের কলেজফ্রেন্ডদের মধ্যে যারা এসেছিল তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল ডুপ্লেক্সের
উপরতলাতে। এটা সাফায়েত স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছিল। তবে বৈষম্য বুঝতে সময় লাগলো না। বিয়ে
বাড়ির ভালো খাবারের আয়োজন যখন ডুপ্লেক্সে উপরতলায় হতো, আন্টি সাফায়েতদের খাবার দিতেন
টিনের ঘরে। আর যখন সবাই মিলে বাড়ির উঠানে খাওয়া-দাওয়া করতো, আন্টি তখন ওদের খাবার
দিতেন দোতলাতে। বিয়ে বাড়িতে খাবারের কষ্টটা কতটা হলে সাফায়াত আর বিপ্লব বাধ্য হয়ে
কয়েক বেলা হোটেলেই খেয়েছে। বিপ্লব অবশ্য চোখ কান বন্ধ করে রাসেলকে ওদের খাওয়ার কষ্টের
কথা জানিয়েছিল। ফলস্বরূপ রাসেল খুব নম্রভাবে দুঃখ প্রকাশ করে আন্টিকে জানিয়েছিল যে
ওর বন্ধুদের খাওয়ার কষ্ট হচ্ছে। আর যেন কষ্ট না হয়। ঠিক তারপর দিন সকালে আন্টি ওদেরকে
আলু ভাজি নিরামিষ সবজি আর ডাল খাইয়েছিল। আগের রাতে রাসেলকে খাওয়ার কষ্টের কথা বলার
পর ওরা আশা করেছিল সকালে অন্তত ভালো কিছু জুটবে। বিয়ের দিন সকালে এমন খাবার পেয়ে
দুজন অবাক। আন্টি মিষ্টি হাসিতে ওদেরকে বললেন আজকে তো বাড়িতে বিয়ে। দুপুরে তো অনেক
ভালো মন্দ খাবে। তাই সকালে খুব বেশি দিলাম না। মানে ব্যাপারটা হল বিয়ে বাড়িতে দুপুরে
ভালো কিছু খাবে, এজন্য আন্টি সকালে ওদেরকে ভালো কিছু খেতে দেয়নি। তবে দুদিন সেখানে
থেকে ওর একটা জিনিস আবিষ্কার করলো আঙ্কেল যেখানে থাকে আঙ্কেলের সামনে আন্টি দয়ার মানুষ
হয়ে যায়। তাই সাফায়াতের বুদ্ধিতে বিপ্লব হঠাৎ আঙ্কেলকে অনেক প্রশংসা করে বললো ওরা
দুজন আঙ্কেলের সাথে একবেলা খেতে চায়। তা না হলে ওদের এখানে আসাটা বৃথা হবে। আঙ্কেল
হাসিমুখেই ওদের আবদার মেনে নিলেন আর আঙ্কেলের সামনেই খাবার টেবিলে যা যা ছিল সব সবাঢ়
করলো ওরা দুজন। যেন গত দুদিনের না খেতে পাওয়ার প্রতিশোধ। আন্টি পাশে দাঁড়িয়ে মুখে
হাসছে আর চোখে তাদেরকে গিলে খাচ্ছে। দুইটা মুরগির রোস্ট, এক গামলা গরুর মাংস, দই, ইলিশ
মাছ, টাঙ্গাইলের বিখ্যাত পোড়াবাড়ির বড় বড় চমচম এক নিমিষেই সব শেষ। আঙ্কেল অবশ্য
মন থেকে মানুষকে খাওয়াতে ভালোবাসেন। তাই ওদের খাওয়া দাওয়াটা আঙ্কেলের কাছে স্বাভাবিক।
আর আন্টি যেহেতু পঁচাবাসি খাবার খাওয়াতে ভালোবাসেন তাই ভালো খাবারগুলো তার চোখের সামনে
এভাবে শেষ হয়ে যাচ্ছে এটা উনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। সাফায়েত আর বিপ্লব
সব বুঝেও না বোঝার ভান করে দেদারসে খাচ্ছে। আঙ্কেলের সামনে আন্টির আর আন্টির হাতের
রান্নার প্রশংসা করতে ভুলে যায়নি ওরা। আন্টিকে যে ওরা সূক্ষ্ম খোঁচা মেরেছে সেটা আন্টি
না বোঝার মত অবুঝ না। কিন্তু পরিস্থিতির মার পেঁচে পড়ে তার সামনেই একে একে শেষ হয়েছে
মজাদার সব রান্না। ক্যাম্পাসে ফিরে রাসেলের মায়ের এসব আচরণে গল্প ওদেরকে বেশ অনেকদিন
হাসিয়েছিল।
No comments