শাহরিয়ার সোহাগ এর "প্রাক্তন"। পর্ব - ২২
শাহরিয়ার সোহাগ এর "প্রাক্তন"। পর্ব - ২২
তুমি হাঁটতে পারবে সেটা জানি। তবে হাঁটতে হাঁটতে আমি মাথা ঘুরে পড়ে গেলে আমাকে নিয়ে হাসপাতালে দৌঁড়াদৌঁড়ি করতে তোমার যে কি পরিমাণ ধকল যাবে আমি সেটা ভেবে কষ্ট পাচ্ছি। যদিও এতটা পথ হাটলে আজ রাতে তোমার ঘুমটা ভালো হবে। তোমার তো রাতে ঘুম হয় না। - হাসতে হাসতে যেন সাফায়েতকে ভয় দেখালো নবনীতা।
কয়েক বছর আগের একটা ঘটনা। কলকাতা থেকে
ঢাকা পর্যন্ত একটা ছেলে পায়ে হেঁটে এসেছে। - বললো সাফায়েত।
হ্যাঁ, নিউজটা পড়েছিলাম। ছেলেটার নাম
ইকরামুল হাসান শাকিল। ছেলেটা দম আছে বলতে হয়। - উত্তর দিলো নবনীতা।
সে আর বলতে! এগারো দিন হেঁটে কলকাতা
থেকে ঢাকা! শারীরিক জোরের থেকে মানসিক শক্তি যে তার বেশি, সেটা মানতেই হবে। ছোটখাটো
দেখতে ছেলেটাকে দেখলে তার স্টামিনা বোঝা ই যায় না। - যোগ করলো সাফায়েত।
শুনেছি সমতল তার কাছে খেলনা। সে তো পাহাড়ের
মানুষ। পর্বতাভীযান নাকি তার প্রিয় কাজ। - বললো নবনীতা।
তার থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়া উচিত।
- এতক্ষণে যেন সুযোগ পেলো সাফায়েত।
কেমন শিক্ষা? - প্রশ্ন করলো নবনীতা।
এই যে আজকে পোলাপপুর থেকে হেঁটে ক্যাম্পাসে
ফিরবো। তারপর আস্তে আস্তে দূরত্ব বাড়বে। ঈদ-পূজার বন্ধে রাস্তায় যে পরিমাণ গাড়ির
জ্যাম থাকে তাতে তো হেঁটেই বাড়ি যাওয়া শ্রেয়, কি বলো প্রেমিকা? - সাফায়েত যেন আর
নবনীতাকে হাটিয়েই ছাড়বে।
তোমার এই পাগলামি যুক্তির সাথে সায়
দিতে ইচ্ছে করছে না। তোমার মাথায় যখন ভূত চেপেছে, জানি এই ভূত আজকে আমাকে হেঁটেই ক্যাম্পাসে
নিয়ে যাবে। তাই সেসব না ভেবে এখনকার সময়টা কে ভালো করি। - প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতে চাইলো
নবনীতা।
গল্পে গল্পে তাদের রিক্সা এসে থামলো
আসিফের মুড়িকলিজার দোকানের সামনে। আসিফের মুখরোচক খাবারের মত ওকে নিয়ে একটা মুখরোচক
গল্প প্রচলন আছে। আসিফের প্রিয় শিল্পীর নামও নাকি আসিফ। কাকতালীয়ভাবে তার প্রেমিকার
নাম নাকি প্রিয়া। আসিফের প্রেমিকা প্রিয়া তাকে ছ্যাকা দিয়ে অন্য কারো সাথে ঘর বেঁধেছে।
শিল্পী আসিফের 'ও প্রিয়া তুমি কোথায়' গানটা মুড়ি মাখানোর সময় প্রায়ই গুনগুন করে
গায় আসিফ। আসিফ বয়সে ত্রিশের কোটায়। বড় গোফ রেখেছে। এটা নাকি ওর শখ। কাজের ফাঁকে গোঁফের
দুই প্রান্ত আঙুল দিয়ে মুড়িয়ে নেয়। সবই ঠিকঠাক, তবে কি একটা বাজে গন্ধের সেন্ট মেখে
সবকিছু মাখিয়ে ফেলেছে। সাফায়েত নিতেই পারছে না গন্ধটা। সাফায়েত মনে মনে ভাবে এই সেন্টের
থেকে তাদের পাদের গন্ধটা আরো বেশি প্রেজেন্টেবল, বাসনা লাগানো। আসিফের এই সেন্টের গন্ধটা
কেমন যেন বিকট। সাফায়েতের ধারনা সরিষা, শুকনা মরিচ পোড়া দিয়ে এক গামলা জাম্বুরা মাখা
খাওয়ার পরে নিশ্রিত পাদের সাথে কিছুটা পঁচা গোলাপ আর পঁচা তরমুজের দারুণ একটা মিক্সিং
করে সেটা ফেসিয়াল করার মত সারা গায়ে মেখেছে আসিফ। স্থান, কাল পাত্র ভেদে জিনিসের মূল্য
নির্ধারণ করা হয়। এই যেমন একটা তাজা গোলাপ বিশ পঁচিশ টাকা। তবে পঁচে যাওয়াতে কোনো দাম
নেই। সেদিন আসিফের সাথে সাফায়েতের সম্মুখ পরিচয়ের প্রথম দিন। তাই তার মন চাইলেও সে
গিয়ে আসিফ কে বলতে পারছে না তার সেন্টের কথা। যদিও না বলতে পারার অন্যতম কারণ নবনীতার
চোখ দুটোকে স্বাভাবিকের তুলনায় কিঞ্চিৎ বড় করে সাফায়েতের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকানো।
এই সময়টাতে আসিফের দোকানে মানুষের ভিড়টা একটু কম।
মানুষজনের আনাগোনা শুরু হয়েছে মাত্র। ভ্যানগাড়ি কাস্টমাইজ করে চলমান দোকান বানিয়ে
নিয়েছে আসিফ। এতে মাস শেষে ঘর ভাড়া লাগে না ঠিকই, তবে প্রতি সন্ধ্যায় সরকারদলের
হাইব্রিড নেতাদের নিয়োগ করা চামচা এসে চাঁদা তুলে নিয়ে যায়। ভিক্ষুকের তো পাঁচ দশ
টাকাতে মন ভরে। তবে এই নেতাদের পেট পাহাড় সমান। রাস্তায় ভ্রাম্যমান দোকান প্রতি প্রতিদিন
চার পাঁচশো টাকা না নিলে তাদের পেট ভরে না। সবাই শুধু বলে তারা কেবল ছাপোষা, টাকাটা
দিতে হয় উপর মহলকে। এই উপরমহল যে ঠিক কত উপরে, নিচের মহলের মানুষের সেটা দেখার সৌভাগ্য
কখনোই হয়নি। সদা হাসিখুশি আসিফ মিয়া তার সমস্ত আয়োজন প্রস্তুত করে অপেক্ষায় আছে
কাস্টমারের। কলিজা দিয়ে দুটো স্পেশাল মুড়ি মাখা অর্ডার করলো সাফায়েত। ক্যাম্পাসের
জনপ্রিয় সাফায়েত এখানে এসে খুব সাধারন কেউ। আসলে সবাই সব জায়গায় রাজা না। রাজ্য
ভেদে রাজা গুলো আলাদা হয়। এক রাজ্যের রাজা অন্য রাজ্যে বেড়াতে যাই পর্যটক হয়ে। এখনকার
রাজ্যের রাজা আসিফ মিয়া।
: আসিফ ভাই আপনার বেশ প্রশংসা শুনেছি।
আপনার এই মজাদার খাবারের গোপন রহস্যটা কি? এতকিছু ছেড়ে এই ব্যবসাতেই বা কেন?
: কি আর দুকখের কতা কবো কন। আমার পেমিকার
নাম ছিল প্রিয়া। তার লগে কতা কওয়ার সুযোগ পাইতাম না। ওর জন্যিই প্রথম মুড়ির দোকান
দিলাম।
: প্রেমিকার জন্য মুড়ির দোকান কেন!
: মুড়ি কিনার অজুহাতে সে আমার লগে দেখা
করতি, কথা বলতি আসতো। কেউ কোনো সন্দেহ করতো না।
: তারপর?
: তারপর আর কি, দিনে কয়েকবার আসতো।
আমারো ভালো লাগতো। তবে প্রিয়া কখনো বিল দেয় নি। প্রথম প্রথম অবশ্য দিতি চাইতো। ভাব
দেখিয়ে আমিই নিতাম না। এরপর সে আর বিল দিতো না। আমিও আর চাতি পারতাম না। সারা দিনে
যা লাভ হতো সেই লাভের টাকায় পেমিকা মুড়ি খেতো। কখনো কখনো লসে পড়ে যাইতাম। আস্তে আস্তে
পরিচিতি বড়লো, ইনকাম বাড়লো। আর প্রিয়া পোল্টি মেরে কইলো মুড়িয়ালার সাথে পেম করা
তার স্টাটাসের সাথে নাকি যায় না।
: এ তো যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর।
: ঠিক কইছেন ভাই, যার জন্য বেচলাম মুড়ি
হেই বলে মুড়িয়ালা। ওরে ভাই, এ কি এক জ্বালা।
: আপনার গল্পটা বেশ মর্মান্তিক।
: মর্মান্তিক ভেবে আবার কষ্ট টষ্ট পাইয়েন
না। আমার এই গল্পটা আমি সবাইরেই কই। তবে এই গল্পের কতটুক সত্য কতটুক মিথ্যে সেইডা নিয়ে
একটা বিরাট বড় ধোঁয়াশা আছে।
: মানে?
: মানে আমি কই আর না কই তার থেকে বড়
কথা হচ্ছে কাস্টমারের আমার কতা শুনোনের সময় হয়না।
: কেন?
: ওই যে মুড়ি খাতি খাতি আমার গল্প শুনে।
আর মুড়ি নরম হয়ে গেলি তো মজাই শেষ। খান খান, তাড়াতাড়ি মুড়ি খান।
আসিফ মিয়া সেদিন সাফায়েত আর নবনীতাকে
প্রিয়ার যে গল্প বলেছিল তা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেনি ওরা। তবে একবারে ফেলেও দিতে
পারেনি।
No comments