শাহরিয়ার সোহাগ এর "প্রাক্তন"। পর্ব - ১৯
শাহরিয়ার সোহাগ এর "প্রাক্তন"। পর্ব - ১৯
আমার স্বপ্নগুলো মরে গেছে। তাই থেকে গেছি আগের সেই জরাজীর্ণ বাসাতেই। একটা সিট নিয়ে উঠেছিলাম। একে একে সবাই চলে গেলো জীবন যুদ্ধের সৈনিক হয়ে। তারপর আমিই থেকে গেলাম। - বললো সাফায়েত।
জায়গাটা এখনো ছাড়োনি তুমি! - অবাক ই হলো নবনীতা।
যেই বাসাতে থেকে বসে লিখে আমার এত অর্জন, স্মৃতিমাখা
সেই বাসাটা ছাড়ি কি করে বলো। আজ একটা জিনিস চাইবো তোমার কাছে? আজ, তোমার এই বিশেষ দিনটাতে
সন্ধ্যা পর্যন্ত তোমার সঙ্গে আমাকে রাখবে? যদি তোমার সময় হয়, তাহলে। আজ তো তোমার জীবনের
বিশেষ একটা দিন। অবশ্য জানি না তোমার কাছে এখন আমার জন্য সময় আছে কি না। এটাও সত্যি
যে আমি তোমার কাছে বিশেষ কেউ না। - বহু বছরের পুরনো আবদার করলো সাফায়েত। কিছুক্ষণ আগেও
এই একই আবদার করলেও নবনীতা স্পষ্ট ভাবে কোনো উত্তর দেয়নি। তাই আবদারের পুণরাবৃত্তি
করলো সাফায়েত।
এত বড় মাপের বিখ্যাত একজন মানুষ, যার জন্য তরুনীদের
ঘুম হারাম, এমন একটা মানুষের সাথে পুরো একটা দিন কাটানোর সুযোগ তো হারাতে চাইনা। অনেকগুলো
বছর আগে তোমাকে ফিরিয়ে দেবার সিদ্ধান্তটা আমার ভুল ছিল নাকি সঠিক ছিল সেটা নিয়ে এখন
ভাবতে চাইনা। আজ আমার জন্মদিন। আমি চাই আজকের দিনটা আমার অন্যান্য দিন থেকে স্পেশাল
হোক। - হাসতে হাসতে উত্তর করলো নবনীতা
।
উদ্যানে বহু কিছিমের মানুষ ঘুরছে, যে যার ধান্দায়। ছেলে বুড়ো সব বয়সের মানুষের
আনাগোনা এখানে। ভার্সিটি পড়ুয়া ছেলে মেয়ে বেশি। কেউ সিগারেট-গাঁজার ধোঁয়া উড়িয়ে গানের
আসরে মজেছে, কেউ প্রেমিকার কোলে শুয়ে, তো কেউ আবার প্রেমিকের চুলে আদর করছে। এদের সবাইকে
মাঝে মাঝে বিরক্ত করছে চা কিংবা ফুল বিক্রেতা। কেউ কেউ ভিক্ষা নিতেও যাচ্ছে। কেউ দেয়,
কেউ দেয় না। কারো কাছে টাকা চাইতে গেলে ভিক্ষুকরা অসহায়ের অভিনয় করে, টাকা নিয়ে চলে
যাবার সময় আবার আসল চরিত্রে ফিরে আসে। আর টাকা না দিলে আসল চরিত্রে বিড়বিড় করে গালি
দিতে দিতে চলে যায় আরেকজনের কাছে ভিক্ষা নিতে। এই স্বভাবটা মখলেস ফকিরের বেশি। উদ্যানের
সবাই কাছে সে মখা ফকির হিসেবে পরিচিত।
তোমার ব্যক্তিগত প্রাক্তন গল্পের শেষ হয়েছিল আমার সন্দেহ
আর রাগ দিয়ে। যদিও আমি এখন জানি তাতে তোমার কোনো দোষ ছিল না। সেটা নেহাৎ ই আমার সন্দেহ
ছিল। - আবারো কথা বলা শুরু করলো নবনীতা।
দেখো, সেদিনের মত আজো বলছি আমি তোমাকে কখনো দোষ দিই
নি। তবে আমি তোমাকে বারবার বোঝানো চেষ্টা করেছিলাম আমি পুরোদস্তুর একজন লেখক হতে চাই।
যখন হুমায়ুন, সুনীল, রুদ্র পড়ি তখন স্বপ্ন দেখি একদিন মানুষ আমার লেখাও খুব আগ্রহ নিয়ে
পড়বে। তখন একেকটা গল্পের জন্য আমাকে গল্পের প্রত্যেকটা চরিত্রকেই কল্পনা করতে হতো।
আমি সব চরিত্রের মধ্যেই তোমাকে ভাবতাম। তবে চরিত্রের পূর্ণতার জন্য অদৃশ্য কাউকে কল্পনাতে
আনতাম। সেটা হোক ছেলে বা মেয়ে। আর আশ্চর্যজনক ভাবে তোমার সন্দেহ ছিল আমার অমুক গল্পের
নায়িকার মুখে তিল, তোমার মুখে তো তিল নেই। আমি তাহলে কোন মেয়েকে ভেবেছি। তোমার বড় চুল,
তবে গল্পের নায়িকার তো ছোট চুল। ওটা তাহলে কোনো মেয়েকে খুশি করতে লিখেছি। গল্পের এই
নায়িকা চরিত্রগুলো আমারই সৃষ্টি। তোমার সেই সন্দেহতে একটা জিনিস বুঝেছি যে আমার লেখাতে
কিছু একটা আছে। এবং তুমি আমাকে অনেক ভালোবাসতে সেসময়। তা না হলে কাল্পনিক একটা গল্পের
কাল্পনিক চরিত্রকে ভেবে লেখক প্রেমিককে সন্দেহ করে তার প্রেমিকা? তাদের পাঁচ বছরের
সম্পর্কটা শেষ করে দিতে পারে? তারপর নিজেকে সামলে আরো অনেকগুলো বই লিখেছি। সবগুলোও
কাউকে না কাউকে কল্পনা করে। - প্রতুত্তর করলো সাফায়েত।
সেটা আমি এখন বুঝতে পেরেছি। তবে জানো তো, সেটা বুঝতে
আমার অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। তোমার প্রতি আমার এই অবিচার আমাকে শাস্তি দেয়, প্রতিটা
মুহূর্তে শাস্তি দেয়। আমি যে ভালো আছি তা কিন্তু না। তোমাকে বিনাদোষে শাস্তি দেবার
শাস্তিটা কয়েক বছর আগে কয়েকগুণ বেশি করে সৃষ্টিকর্তা আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। তার প্রতি
আমার কোনো অভিযোগ নেই। একটা কথা আছে না, সৃষ্টিকর্তা যা করেন ভালোর জন্য করেন। তোমার
সাথে জেদ করে হঠাৎ সিদ্ধান্তে বিয়ে করেছিলাম। সেটা পরিবারের সিদ্ধান্তেই। তবে আমারও
সম্মতি ছিল। তবে কি থেকে কি হয়ে গেল। তারপর পরিবার, সমাজ সবার থেকে আমি নিজেকে গুটিয়ে
নিয়েছি। এখন রেডিওতে যে হেসে হেসে কথা বলি, সেটা পেট চালানোর জন্য। বলতে পারো পেট চালানোর
জন্য জোর করে হাসি। - সম্পর্ক বিচ্ছেদের পরের সময়ের কথা বলতে গিয়ে থেমে গেলো নবনীতা ।
বলো কি? আমি তো কিছুই জানি না এসবের। - যেন আকাশ থেকে
পড়লো সাফায়েত। সেই সাথে কৌতূহল। ভালোবাসার মানুষ নিজের না হলে যে তাকে ভালোবাসা যাবে
না, তেমনটা নয়। যাকে ভালোবাসা হয়, তার প্রতি ভালোবাসাটা আজীবনের।
তুমি তো আমাকেই খুঁজে পেলে বহু বছর পর। আমি তো নিজে
থেকেই হারিয়ে গিয়েছিলাম। আত্মহত্যা মহাপাপ। তাই নিজেকে মেরে ফেলতে পারিনি। তুমিই বা
কোন দুঃখে আমাকে মনে রেখেছো? তোমার জীবন তছনছ করে দেওয়া আমাকে এতগুলো বছর মনে রেখেছো
কেন? - এবার আর নিজেকে সামলাতে পারলো না নবনীতা। হুহু
করে কেঁদে উঠলো। বছর পাঁচেক আগের সাথে এখন কোনো অমিল নেই নবনীতার।
পরিস্থিতি সামলাতে লোকলজ্জা ভুলে নবনীতার ভেজা চোখদুটো আঙুল দিয়ে মুছে ওর মাথাটা
নিজের বুকে নিলো সাফায়েত। মানুষ নিজের থেকে প্রিয় মানুষের মৃত্যু নিয়ে বেশি চিন্তা
করে। প্রিয় মানুষের চোখের পানি মানুষের সবচে কষ্টের। এটাও সত্যি মানুষের প্রিয় মানুষও
পরিবর্তনশীল।
No comments