শাহরিয়ার সোহাগ এর "প্রাক্তন"। পর্ব - ৯
শাহরিয়ার সোহাগ এর "প্রাক্তন"। পর্ব - ৯
একবার ব্যবহারের কাপে দুজন দু কাপ চা
নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গেল বাদামতলার পাশের উদ্যানে। একসময় হাত ধরে হাটার ভয়ানক একটা
অভ্যাস ছিল ওদের দুজনেরই। সময়, মন আর সম্পর্কের দূরত্বে এই অভ্যাসটার কথা কেউ মুখ ফুটে
বলছেও না, তবে বুক ফাটছে দুজনেরই। সাফায়েত একবার ভাবলো যে পুরনো অভ্যাসের কথা মনে করিয়ে
দেখবে নবনীতা কিভাবে নেয় ব্যাপারটা। তবে বলতে যেয়েও বলেনি। সাফায়েতের একবার খুব ইচ্ছে
করছিল হাত ধরে না হোক একটু গা ঘেঁষে হাটবে। তবে এত বছর পর হঠাৎ দেখাতে নবনীতা যদি ভালোভাবে
না নেয় তবে সারা দিনের সব ইচ্ছেগুলো শুরুতেই শেষ হবে। এসব ভেবে নিজেকে বন্দি রাখলো
সাফায়েত।
তাদের সেই হাটাপথ উদ্যানের এক কোনায়
জারুল গাছের দিকে চলমান। অবচেতন মনেই যেন দুজনের গন্তব্য এই জায়গায়, জারুল তলায়। ওদের
প্রেমের সময়ের নিরব বন্ধু ছিল এই জারুল গাছ। এই জারুলতলায় ওদের অনেকটা সময় কেটেছে।
ওদের প্রেমের সেই সময়টাতে এখানে গানের আসর বসতো। গান পাগল রমিজ ভাই সবাই কে ডেকে ডেকে
গান শোনাতো। রমিজ ভাই যেমন ভালো গাইতো, তেমনি মানুষটাও ভালো ছিল। ডান পা একটু টেনে
হাটতো, কাঁধ ছাড়ানো চুল ছিল রমিজ ভাইয়ের। একবার গলা ছেড়ে গাওয়া শুরু করলে আট দশ জন
মানুষ জড়ো হয়ে যেত। কখনো কখনো এরও বেশি। নবনীতা সাফায়েতও তার গান শুনেছে অনেক। আব্দুল
করিমের গানগুলো বেশ দারুণ শোনাতো রমিজ ভাইয়ের গলায়। যদিও গান নিয়ে তার নাকি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক
শিক্ষা ই ছিল না। তখনই তার বয়স ষাট ছুঁই ছুঁই, তবে ষাটের বেশি হবে না। কাঁধ ছাড়ানো
ধবধবে সাদা চুলের জন্য কেউ কেউ তাকে সাধু বলেও ডাকতো। এখন এখানে আসে কি না কে জানে?
সময়ের সাথে সাথে জীবনের গতিপথও তো বদলে যায়। বেঁচে থাকলে হয়তো অন্য কোথাও জীবনের মানে
খোঁজে। হয়তো বেঁচে নেই। হয়তো এখানেই মাঝে সাঝে আসে রোগবালাই সাথে নিয়ে।
জারুলের ফুলের বেগুনি বর্ণ যেমন ভালো
লাগতো নবনীতার তেমনি এর শোভন-সুন্দর পাঁপড়ির নমনীয় কোমলতায় প্রেম খুঁজে পেতো সে।
ছয়টা খোলা পাঁপড়িতে একটা আস্তো ফুল। যদিও এর রং বেগুনি, তবুও অনেক সময় এর রং সাদার
কাছাকাছি এসে পৌঁছায়। সেই সময়টাতে নবনীতা আর জারুলের মধ্যে অদ্ভুত এক মায়ার মিল খুঁজে
পেতো কবি সাফায়েত। যেন তার কবিতা লেখার সাধনা লুকিয়ে আছে এই দুইয়ের মাঝেই। বাদামতলাতে
আসলে উদ্যানে একবার আসতেই হতো সাফায়েতের। আর সাফায়াতের বদৌলতে নবনীতারও ঘুরে দেখা
হতো এই সবুজ রাজ্যটা। সাহিত্যিকরা যতটা না প্রকৃতিপ্রেমিক হয় তার থেকে বেশি নির্জনতা
প্রেমী হয়। প্রকৃতি হলো নির্জনতার একটা অংশবিশেষ। যেখানে সে তার মত করে ছন্দের সাধনা
করতে পারবে। প্রকৃতি বড়ই রহস্যময়ী, ঠিক যতটা রহস্যময়ী একটা যুবতী মেয়ে। রহস্য ভেদ
করে চায়ে চুমুক দিয়ে কথা বলা শুরু করলো সাফায়েত - আমাদের চাহিদার কারণে গত তিন শতাব্দীতে
এর পাতার ধরণে পরিবর্তন এসেছে বিভিন্ন মহাদেশজুড়ে, কিন্তু এর আবেদন একই রয়ে গেছে।
উটের কাফেলা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক বিপ্লব, এমনকি পারলৌকিক জীবনের অনুষঙ্গ হয়ে চা
মানবজাতির জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে।
চা পানের শুরু চীনে, চীনের ইয়াং লিং সমাধিস্তম্ভে প্রাচীনকালে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াতে
যেসব নৈবেদ্য দেয়া হতো তার মধ্যে পাতা দিয়ে তৈরি শুকনো কেক দেখা যেতো। এইসব পাতার
মধ্যে থাকা ক্যাফেইন এবং থিয়ানিন প্রমাণ করে যে, সেগুলো প্রকৃতপক্ষে ছিল চা পাতা যা
কিনা মৃতদের সাথে দিয়ে দেয়া হতো তাদের পারলৌকিক জীবনের অনুষঙ্গ হিসেবে। দুশো বছর
আগে এভাবে চায়ের ব্যবহার হয়েছিল।
অনেককিছুই জানো তুমি। লেখক বলে কথা।
- চায়ের চুমুক দিয়ে কথা বলা শুরু করলো নবনীতা।
মুরব্বীরা একটা কথা বলে- নারীর মন বোঝার
থেকে যুদ্ধজয় সহজ। সেখানে আমি কেবল চা নিয়ে বলেছি। - চায়ের কাপে মৃদ্যু চুমুক দিয়ে
উত্তর দিলো সাফায়েত।
তোমার ক্ষেত্রে কোনটা? - সুযোগে নিজের
কাপে চুমুক দিয়ে প্রশ্ন করলো নবনীতা।
আমার উত্তরটা ঠিক একই। - উত্তর দিলো
সাফায়েত।
কেন? - নবনীতার পাল্টা প্রশ্ন।
এই যে আমি কখনো তোমার মন বুঝিনি। তুমি
কি চেয়েছো সেটা কখনো বুঝতে চাইনি। - নিজের কাঁধে যেন সবটুকু দোষ নিতে চায় সাফায়েত।
No comments