শাহরিয়ার সোহাগ এর "প্রাক্তন"। পর্ব - ৪
শাহরিয়ার সোহাগ এর "প্রাক্তন"। পর্ব - ৪
আরে সাফায়েত মামা যে। হাজার বছর পর দুজন
একলগে কই থ্যাইকা উদয় হইলেন। আমি তো ভাবছিলাম বিখ্যাত হইয়া আমাগোরে ভুইলাই গ্যাছেন
গা। আপনারে তো এহন টিভিতি, পেপারে দেহি। আপনে তো এখন বড় মাপের লেখক। - দূর থেকে চা
বানানোর ব্যস্ততার মাঝেও সাফায়েত কে চিনে ফেললো সামাদ মামা। হাস্যোজ্জ্বল সাদা মনের
মানুষ সামাদ মামা। এই মানুষগুলোকে কখনোই টাকা দিয়ে কেনা সম্ভব না। তবে এক গাল হাসিতে
অনায়াসেই কিনে নেওয়া যাবে এদেরকে। সব মানুষই মাটির তৈরী, তবে এই মানুষগুলো যেন সত্যিকারের
মাটির মানুষ। স্বভাবসুলভ আচরণে কি নমনীয়! চায়ের দোকানগুলো কখনো বুড়ো হয় না। এই জায়গাটা
যেন চিরযৌবন ধরে রাখার মন্ত্র জানে। চুল পড়ে কপালটা আগের থেকে বড় হয়েছে সামাদ মামার। তবে কপাল খোলেনি এত বছরেও। প্রাপ্তি কেবল কপালে
সমন্তরাল কয়েকটা সরু ভাঁজ। এই ভাঁজের কারণ অবশ্য আছে। সামাদ মামার বউ অনেক বছর ধরে
বিছানায় পড়ে আছে। ছেলে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি নিয়ে সংসার আলাদা করে নিয়েছে। মুখে
শক্ত ঘণ চাপদাঁড়ি। সাদা হতে শুরু করেছে। চামড়ায় ভাঁজ পড়া, মাথায় টাক পড়া সামাদ মামা
যেন এখনো যেন পঁচিশ বছরের যুবক। মুখ টিপলে দুধ বের হওয়া টাইপের পিচ্চি পোলাপান তাকে
তুমি বলে ডাকে, সে শুধুমাত্র চায়ের দোকানদার বলে। অথচ সামাদ মামা বড় ছোট সবাইকে আপনি
করেই সম্মোধন করে। অন্যকে সম্মান করলে সম্মান পাওয়া যায়; এই প্রবাদে আংশিক পরিবর্তন
এখন সময়ের দাবি মাত্র। গরিবরা বড়লোকদের প্রতি যতবেশি সম্মান দেখায়, বড়লোকরা গরিবদেরকে
ততবেশি অসম্মান করে। তাতে অবশ্য আফসোস করে না সামাদ মামা। এসব ছোটখাট ব্যাপারে আফসোস
করলে কি আর ব্যবসা টিকবে!
কালো চুলের সামাদ মামার চুল সাদা হয়েছে,
তাতে মেহেদী রঙের ছিঁটেফোটায় চুলগুলো হালকা বাদামী হয়েছে। মুখে স্থায়ী চাপ দাঁড়ির জন্য
গালের কাটা দাগটা ঢাকা পড়েছে। সামাদ মামার চেহারায় বয়সের ছাপ স্পষ্ট হতে শুরু করেছে।
কয়েক স্বাদের চা ছাড়িয়ে মালাই চা, গুড়ের চা, মরিচ চা, জয়পাই চা, মাল্টা চা, লেবু চা,
পনির চা, ককটেল চা, এ্যাটোম বোমা চা, এমনকি চিনা বাদাম হামান দিস্তায় বেটে বাদাম চা,
এরকম গুনে গুণে সতেরো পদের চায়ের জন্য বাদামতলাতে সামাদ মামা সবচে আলোচিত চা বিক্রেতা।
এসব চায়ের আবার নরমাল আর স্পেশাল ভার্সন আছে। স্পেশাল ভার্সন পরিমাণে বেশি, দামও বেশি।
এসব খোঁজ সাফায়েত আগে থেকেই জানতো। তবে আসা হয়ে উঠতো না।
হারাইনি মামা। এলাম তো। - হাসতে হাসতে
উত্তর দিলো সাফায়েত।
কোতায় আছিলেন মিয়া এতদিন। আপনাদের দুজনকে
কত বছর পর একলগে দেখলাম কন দেহি। - এক হাতে চায়ের কেটলি আর অন্য হাতে ছাঁকনি নিয়ে চায়ের
কাপে চা ঢালতে ঢালতে প্রশ্ন করলো সামাদ মামা। আমাদের দুজনের পৃথিবী তো এখন আলাদা মামা।
আর ঘুরতে ঘুরতে আজ যখন এত বছর পর হঠাৎ দুজন কাছাকাছি হলাম তখন বাদামতলাতে এলাম আপনার
হাতের চা খাবো বলে। - হাসতে হাসতে উত্তর দিলো সাফায়েত।
আপনে কবি মানুষ। আপনার কথা তো আমার ছোড
মাথার উপ্রে দিয়া যায় মামা। কি চা খাবেন হেইডা কন? - অন্য কাষ্টমারকে ম্যানেজ করে ততক্ষণে
সাফায়েতদের সাথে ততক্ষণে গল্প জমিয়ে ফেলেছে সামাদ মামা। বহু কাল প্লাস্টিকের বস্তায়
আটকে থাকা সাপের বাচ্চাগুলো প্যাকেটের মুখ খুলে বের হবার সুযোগ পেলে যেমন বিচলিত হয়ে
যায়, সামাদ মামার মুখের কথাগুলোও যেন ঠিক তেমনটা।
কি আর খাবো। যেই চা খাইয়ে পাগল বানিয়েছিলেন,
দুইটা স্পেশাল গুড়ের চা দিয়েন। আমারটাতে চিনি কম দিয়েন। - উত্তর দিলো সাফায়েত। বলতে
না বলতেই সামাদ মামার এক চ্যালা চা নিয়ে হাজির। এইটাকে আগে কখনো দেখেনি। মনে হয় নতুন
মুরিদ। এজীবনে তো আর কম লোক মুরিদ হইলো না সামাদ মামার। কই থেকে জানি সসামাদ মামা এসব
ডিমের বাচ্চা আনে। চোখ মুখ ফুটলে সামাদ মামারে রেখে তারা চলে যায়। দুনিয়ায় সবাই নিজের
স্বার্থ খোঁজে। নতুন মুরিদ সাফায়েতদের বসার জন্য একটু পাশে একটা জায়গা মুছে দিলো।
No comments