Header Ads

কিছু গল্পের নাম থাকে না

 

কিছু গল্পের নাম থাকে না, Shahriar Sohag;


কিছু গল্পের নাম থাকে না


রাজধানীর জিগাতলাত বাসস্টান্ড থেকে ট্যানেরিমোড়ের দিকে রাস্কায় দশমিনিট এগোলে গাবতলা মসজিদ। আর তার একটু আগে বামদিকে কলোনীর গলি। গলির মোড়ে বেশকিছু দোকান, খাবারের হোটেল। এই গলিতেই একটা বাসাকে একটা রুম ভাড়া নিয়ে সাবলেট থাকতো ছেলেটা। ভোটার আইডি কার্ড দেখে তার নামা জানারগেল রূপন। রূপন হোসাইন। রূপনের সাথে ওর একটা বন্ধুও থাকতো। সে একটা কল সেন্টারে চাকরি করতো। এই লকডাউনে তা অফিসবন্ধ ছিল। তাই সে গ্রামে চলে গেছে। চায়লে রূপনও বাড়িতে চলে যেতে পারতো। তাহলে এই সময়ে তার ঢাকাতে থাকার দরকার কি?
এই প্রশ্নটার উত্তর আগে খুঁজতে হবে। - মৃদ্যু আওয়াজে কথাটা বলে ডায়েরীতে নোট করলেন জামশেদ।
জামশেদ রহমান। এখানকার থানাতে চাকরি করেন। তদন্তকারী কর্মকর্তা হয়ে করোনার এই মহামরারীতে ফাকা ঢাকার নিরাপত্তা দিচ্ছেন। 

কোয়ারেন্টাইনের এই সময় সে একা এই বাসাতে ছিল। তার রুমমেট, যাদের সাথে সাবলেট থাকে, এমনকি পুরো বিল্ডিং কেউ নেই। দারোয়ানও ছুটিতে। বাড়ির মালিক তার অন্য একটা বাড়িতে থাকেন। এই বাড়ির দারোয়ান জামাল মিয়া পুরো বাড়ি দেখাশোনা করেন। তবে এই ছুটিতে সেও তার গ্রামের বাড়ি বরিশাল চলে গেছে পরিবারের সাথে কিছুদিন বেশি থাকার আশায়। তার রুমমেট যে ঢাকাতে ছিল না সেটা এরই মধে নিশ্চিত হতে পেরেছে জামশেদ।

রূপনের ঝুলন্ত বড়ি নামিয়ে ততক্ষণে ডেডবটি নেওয়ার সাদা প্যাকেটে ভরে ফেলেছে সঙ্গে থাকা দুজন কনস্টেবল। পুরো রুমে ক্লু খোঁজার চেষ্টা করছে জামশাদের তীক্ষ চোখ।
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সে তার পড়ার টেবিলে বসেই ডায়েরী লিখছিল। কফি খেয়ে এঁঠো করা রংচটা দুটো সিরামিকের কাপ টেবিলের উপরই ছিল। একটা কাপে বামপাশে চুমুক দেওয়া, অন্য কাপটাতে ডানপাশে।
যদি বাসাতে রূপন একাই থাকে ঘটনার সময়, তাহলে লেখার সময় ডান পাশে চুমুক দেওয়া কাপের কফি সে লিখতে লিখতে খেয়েছে। আর বাম পাশে চুমুক দেওয়া মগের কফি সে খেয়েছে লেখার আগে বা পরে। জামশেদের এই ধারনা রুমে পাওয়া রূপনের একটা ওয়াশ করা ছবি দেখে। একটা মেয়ের সাথে তার একটা ছবি, যে ছবিটা রূপন সেলফি তুলেছে। ডান হাতে সেলফি তোলা থেকে জামশেদ এটুকু প্রাথমিক ধারণা করেছে রূপন ডানহাতি ছিল। তবে বাসাতে অন্যকেউ ছিল কি না সেটা দেখতে হবে। তদন্তের আগে কল্পনাতে দুই আর দুই চার মেলানো যায়, তবে দায়িত্বশীল হয়ে সেটা বলাটা যৌক্তিক নয়। দুই আর দুই যে চার হবে, সেটারও প্রমাণ হওয়া আবশ্যক।

রাতের জন্য রান্না করা তরকারিটা তখনো হালকা গরম ছিল। ঢেকে রাখা তরকারিটা শুকে দেখলো জামশেদ। তরকারি ঠিকই আছে। সিম পটলের তরকারিতে সিদ্ধ ডিম ছিল দুইটা। এই বন্দি সময়ে সে একাই রান্না করে খেত। বাসা থেকে বেরই হত না। ভাতের পরিমাণ একজনের জন্য স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি। তবে তরকারি ছিল দুজনের খাওয়ার মত। হতে পারে সে আরেকবেলার জন্য তরকারি রান্না করে রেখোছে। তাহলে ডিম দুইটা সিদ্ধ করার কারণ কি? তাহলে কি বাসাতে কেউ এসেছিল! এসব প্রশ্নগুলো মেলানোর চেষ্টা করছে জামশেদ রহমান।

রূপনের বিছানাটা অগোছালো। কাঁথাটা ভাঁজ করা নেই। গিটারটা ব্যাগ থেকে বের করে বিছানাতেই ফেলে রাখা। রুমে ঝুলে থাকা ক্যালেন্ডারে গতমাসের পৃষ্ঠা। মাস বদলে যাবার পরও পৃষ্ঠাটা বদলানো হয়নি। রুমের দুটো জানালার একটা বন্ধ ছিল। অন্য একটা জানালা খোলা ছিল। খোলা জানালা দিয়ে বিল্ডিং এর বাইরে খুব ভালো মতই দেখা যায়। বন্ধ জানালাতে পর্দা ভিড়ানো ছিল। টেবিলের নিচে রাখা বোয়মে বেশকিছু শুকনো খাবারও ছিল। বিস্কুট, টোস্ট। চানানাচুর, মুড়ি, প্যাকেট কফি এসব।

টেবিলে মেলে রাখা ডায়েরীটা চেয়ারে বসে পড়া শুরু করলো জামশেদ। মানুষ থেকে ডেড বডি হবার আগ মুহূর্তে রূপন এই ডায়েরী নিয়েই ব্যস্ত ছিল। টেবিলে মেলে রাখা ডায়েরীটা সেটারই প্রমাণ দেয়। তাহলে কি তার এই প্রস্থানের কোনো কারণ এই ডায়েরীতে, তার লেখাতে লুকিয়ে আছে? এমন বেশকিছু প্রশ্ন জট পাকিয়ে জামশাদের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
পরিবারের সাথে কদিন যাবত ভালো সম্পর্ক যাচ্ছিল না রূপনের। সে লেখালেখি করতে পছন্দ করতো। তবে তার পরিবার সেটা পছন্দ করতো না। রূপন কবিতা লিখতো। তবে তার বাবার ইচ্ছে ছিল বাড়ির বড় ছেলে চাকরি করবে। আর রূপনের কথা হল লেখালেখি করেও জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায়। তারই প্রমাণ করবে সে। তবে মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে লেখালেখি করবে কেন? তাকে অবশ্যই চাকরি করতে হবে। আসলে আমাদের ক্রিতদাস অগ্রজ শ্রেণী তাদের অনুজদেরও ক্রীতদাস বানিয়ে রাখতে চায়। নিজে থেকে কিছু করার দরকার নেই। কেউ একজন কোনো এক সময়ে কোম্পানী প্রতিষ্ঠা করেছিল, একন যাও তার কাছে তোমার শ্রম বিক্রি করো মাস চুক্তিতে। তবে নিজে যে কিছু করে আরো দশজনের চাকরির ব্যবস্থা করবে, অথবা সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত নিজের ভেতরের মেধাকে কাজে লাগিয়ে অনন্য হবে।

সেটাতে সবচে বড় বাঁধা হল এই মধ্যবিত্য পরিবারগুলো। তাদের কাছে জীবনের মানে মানেই জন্ম মৃত্যির মাঝখানে যতদিন বাঁচবা তার অর্ধেক সময় বই মুখস্ত করে বাকি অর্ধেক সময় মুখস্ত পড়া উগ্রে দেবার যোগ্যতা অনুযায়ী অরেক জনের গোলামী করার যোগ্য যদি তোমার না থাকে তাহলে তোমার জীবনটাই বৃথা।
যেন নড়েচড়ে বসলো জামশেদ। কথাগুলো কি রূপন ওকে বললো নাকি নিজের কথা পায়েরীতে লিখেছে। প্রেমিকাকে লেখা প্রেমপত্রে জামশেদ মাঝে মাঝে কবিতা লিখতো। তাতে প্রেমিকার অভিমানী মনও গলতো। তখন জামশেদ ভেবেছিল সে কবি হবে। চাকরি করে হাজার জনের একজন না হয়ে নিজের প্রতিভা দিয়ে দেশের দশজনের একজন হবে। তার লেখাতে যেন সবার মন ভালো হয়। অস্বাস্থ্যকর এই পৃথিবীতে কোনো বিজ্ঞানী মন ভালো করার ওষুধ এখনো আবিষ্কার করতে পারেনি। তবে পাঠক মন পুলকিত হয়েছে বহুবার, এবং সেটা কোনো না কোনো লেখকের লেখনীতেই। তবে বাড়ির বড় ছেলেদের কবি হওয়াটা বিলাসীতা ছাড়া কিছুই নয়। তাই তো সবকিছু ঝেড়ে ফেলে বাজার খেকে সাধারণ জ্ঞানের বই মুখস্ত করে অনেক চাকরির পরীক্ষা দিয়ে এই পুলিশের চাকরিতে আসা। যদিও চাকরির জন্য মুখস্ত করা রবিন্দ্রনাথের জন্ম তারিখ, +++ দেশের মুদ্রা +++ ++ দেশের রাজধানী ++ কিংবা তখন সময়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিল জর্জ বুশ, এগুলো আসামী ধরতে, আইন শৃঙ্খলার কাজ করতে এখনো পর্যন্ত দরকার পড়েনি।
এসব ভাবতে ভাবতে আবারো ডায়েরীর পাতায় চোখ রাখলো জামশেদ। বর্তমান সমাজ ব্যাবস্থা নিয়ে রূপন ছিল বেশ সোচ্চার। বেশ প্রতিবাদী, অন্যায়ের সাথে আপোষ করে না। ফেসবুকে বেশ এ্যাকটিভ ছিল রূপন। দেশ, সমাজ দিয়ে প্রতিবাদী পোস্টের পাশাপাশি বেশ মজার মজার পোস্টও দিতো। আর তাতেই বিপত্তির শুরু। রূপনের বাবা নতুন ফেসবুক একাউন্ট খুলেছেন। এবং উনি একমাত্র রূপনকেই ফলো করেন ফেসবুকে। রূপন কোনো পোস্ট দিলেই এই পোস্ট সে কেন দিয়েছে, কোনো ছবি পোস্ট করলে এই ছবি সে কেন পোস্ট করেছে এমন জবাবদিহিতায় রূপন রীতিমত অতিষ্ঠ হয়ে গেছে। তারউপর আবার এলাকার মুরব্বী সমাজও সমালোচনা করতে ঢের সময় নিয়ে বসে আছেন। অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা সেটা তাদের দেখলেই বোঝা যায়।
দেশের বর্তমান সময়ে সবাই ফেসবুকে প্রতিবাদী লেখা লিখলেও তার বাবা সেটা বুঝবেন না। উনার একটাই কথা- রূপন কেন করবে? হাস্যকর ব্যাপার হল তার বাবা ব্যক্তিগত ভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নুল কে পছন্দ করেন তার প্রতিবাদী আচোরণের জন্য। তিনি খুব প্রশংসাও করেন নূর কে। তবে নিজের ছেলে প্রতিবাদী কথা বলেই সমস্যা। এমনও হয়েছে রূপন ঘুমাচ্ছে আর রূপনের বাবা ওকে ফোন করে ঘুম থেকে ডেকে তুলে তার পোস্টের জন্য শত প্রশ্ন করছেন। এসব ছোচট ছোট কারণে বাড়ির সাথে রূপনের সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। এডাল্ট পোস্ট করলে পরিবারের মানসম্মান রাখতে জানো না? রোমান্টিক স্টাটাস দিলে ছেলে নষ্ট হয়ে গেছে, তোকে কি ঢাকা পাঠিয়েছি এসব করতে? এধরনের কথা শুনতে শুনতে রূপন অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিল। এমনকি গালাগালি পছন্দ না করা ছেলেটা তার বাবির কাচে প্রতিনিয়ত কুকু, শুয়র, জানোয়ার শুনতে শুনতে রূপন যেন ক্লান্ত হয়ে গেছে। এই ব্যাপারগুলো রূপনকে আরো জেদী করে তুলছিল। তাহলে কি আজ তার জেদের শেষ পরিণতি হল?
কয়েকটা ফাঁকা পৃষ্ঠা উল্টে চোখ আটকে গেল জামশেদের।
(হত্যার হুমকির ডিটেল্স)

কদিন আগেও নাকি প্রতিবাদী লেখার জন্য রূপনকে কে বা কারা হুমকি দিয়েছিল। "আল্লাহু আকবর, রেডি " এমন একটা ম্যাসেজ দিয়েছিল কে বা কারা। তারপর অবশ্য রূপন হাজারীবাগ থানাতে জিডি করেছিল। তবে তার পরিবার এই হুমকির কথা জানতো না।
নড়েচড়ে বসলো জামশেদ। রূপনের ফেসবুক আইডি সার্চ করে তার পোস্টগুলো পড়ে দেখছে জামসেদ। কি এমন লেখা লিখতো রূপন। তার এই মারা যাওয়া কি আত্মহত্যা নাকি হুমকির পরবর্তী ধাপ- খুন? ঘটনা নতুন মোড় নিচ্ছে এই জীবন নাষের হুমকির ঘটনা থেকেই।
রূপন বর্তমান মন্ত্রী পরিষদের বেশ কয়েকজন মন্ত্রীর সমালোচনা করছে তা পোস্টে। তবে জামশেদ সরকারি কর্মচারি হওয়াতে সেই মন্ত্রীদের সমালোচনা করতে নারাজ। সরকারি চাকরি না করে শুধুমাত্র বাংলাদেশের নাগরিক হত, তাহলে হয়ত অনেককেই ধুয়ে দিত। একটা পোস্টে চোখ আটকালো জামশেদের। তবে সেটা রাজনৈতিক পোস্ট নয়। "বিজ্ঞানীর গবেষণাগারে। আর বাইরে অপেক্ষায় আছে হেডামওয়ালা ধর্মীয় যাজকরা। গবেষণা শোষ হলেই তারা ধর্মীয় বানী দেওয়া শুরু করবে।" স্বাভাবিক ভাবেই যেন কোনো ধর্মের ধর্মীয় গোড়ামীর মানুষদের গায়ে লাগবে কথাটা। তার মৃত্যুর সাথে এই পোস্টটার সম্পর্ক থাকতে পারে। সন্দেহের ডালপালা বড় হতে শুরু করেছে। তবে রূপনের পোস্টটা জামশেদেরও মনে ধরেছে। এখন তো ডাক্তার বিজ্ঞানীদের চোখে মুখে ঘুম খাওয়া নেই। দিনরাত এক করে মানবমুক্তির কাজ করছে। গবেষনা করছে। অথচ ধর্শীয় যাজকরাএকন জেগে জেগেই ঘুমাচ্ছে। প্রতিষেধক আবিষ্কারের পর তা ঘুম থেকে উঠে লাফালাফি করবে। ধর্মীয় ব্যাপারে কথা বলাতেই কি রুপনের প্রাণনাশ করা হয়েছে?
আবারো হিসাব মেলাতে ডায়েরীতে চোখ রাখলো জামশেদ। রূপনের প্রতিটা লেখা পড়ে রহস্য খোঁজার চেষ্টা করছে জামশেদ।

রূপনের প্রেমিকার নাম নীহা। টেবিলে যে মেয়েটার সাথে রূপনের ছবি ছিল তার নাম নীহা। বছর দুয়েক আগে বইমেলাতে ওদের পরিচয় হয়। তারপর পরিচিত মুখ থেকে কাছের মানুষ, মন দেওয়া নেওয়া। সেদিন বইমেলাতে কফিও খেয়েছিল ওরা। তারপর এক সন্ধ্যায় রূপন গিয়েছিল কাকরাইলে নীহার এলাকাতে, নীহাকে নিয়ে হাতিরঝিল ঘুরবে বলে। সেদিনই তাদের প্রথম একসাথে রিক্সাভ্রমণ।বেইলী রোড হয়ে, মগবাজার ক্রস করে এফডিসির মোড়ে রিক্না থোকে নেমে পুরো হাতিরঝিল সেদিন সন্ধায় ওরা হাত ধরে হেটেছিল। একটাবারের জন্যও ওরা হাত ছাড়েনি। শুধু হাত ঘেমে গেলে হাত বদলে নিয়েছিল। সেদিনই রূপন জানা হয়েছিল নীহার প্রিয় ফুল বেলী আর রূপনের পছন্দ শিউলী। নেহার পছন্দ ভর্তা, মাছ, ভাত। আর রূপনের বার্গার, পিজ্জা হাতিরঝিল ফুটপাত হয়ে বেগুনবাড়ির দিকে যেতে যে লাল সিঁড়ি, সেখানে ওরা আড্ডা দিয়েছে বহু সন্ধ্যা। ভিকানূননেছা স্কুলের যাত্রী ছাউনীতে বসে নীহা রূপনকে গানও শুনিয়েছে বহুবার। শান্তিনগর মোড় থেকে রাজারবাগের রাস্তা ধরে একটু এগোলেই যে বার্গারের ছোট্ট দোকানটা, ওখানে নীহা প্রায়ই রূপনকে বার্গার ট্রিট দিত কোনো কারণ ছাড়াই। নীহার রাগ ভাঙাতেরূপন বেলীফুল এনে নীহার অভিমানী মুখে হসি ফুটিয়েছে বহুবার।
একদিন বিকেলে রিক্সায় ঘোরার সময় কোনো কিছু না ভেবেই নীহা হঠাৎ চুমু দিয়েছিল রূপনের গালে। সেটাই ওদের প্রথম চুমু। আমৃত্যু সেই স্মৃতি মনে রাখার প্রতিজ্ঞা করেছিল রূপন।এর মধ্যে নীহার এ্সামের সময় রূপন গার্ডিয়ানের মত কেয়ার দিত নীহার। শুধু মাত্র ডাব খেকে আর অনেকক্ষণ একসাথে হাটবে বলে শান্তিনগর মোড় থেকে এজিভি কলোনীর সোজা রাস্তাটায় ফুটপাত ধরে হেটে যাওয়া আসা করেছে বহুদিন। রূপন নীহাকে নিয়ে অসংখ্য কবিতাও লিখেছে। নীহার অভিমান ভাঙাতে, ওর মুখে হাসি ফুটাতে নীহাকে নিয়ে কবিতা লিখতো রূপন। ওদের মধ্যে চমৎকার এক বিনিময় প্রথার প্রচলন ছিল। রূপর নীহাকে নিয়ে যতগুলো কবিতা লিখতো, নীহা রূপনকে ততগুলো এক্সট্রা চুমু দিত।
তাদের প্রেম তো ভালোই চলছিল। তাহলে প্রেমঘটিত কোনো সমস্যার জন্য হয়ত আত্মহত্যা করকে না রূপন। - ভাবতে ভাবতে আবারো পড়াতে মস দিল জামশেদ।

রূপনের গত কয়েকদিনের প্রেমের সময়গুলো ভালো যাচ্ছিল না। লক ডাউনের আগে থেকেই ওদের দুজনের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি চলছিল। রূপনের থেকে বছর খানেকের ছোট নীহা তখন অনার্সের ছাত্রী। আর রূপনন তখন মাস্টার্সের। রূপনের বাবার মত নীহাও রূপনকে চাকরির জন্য চাপ দিতে থাকে। তাও আবার যেন তেন না, সরাসরি বিসিএস। কারণ তার পরিবারের পছন্দ বিসিএস জামাই। আর তাতেই মনোমালিন্যের শুরু। সব রূপনকেই কেন করতে হবে? এতদিন প্রেম করে নীহা তবে কি করলো? রূপনকেই কেন বদলাতে হবে? রূপন লেখালেখি করেই প্রতিষ্ঠিত হবে। রূপনের স্বল্প আয়ে যদি নীহা চলতে না পারে তাহলে বিয়ে পর্যন্ত যাওয়ার দরকার কি সম্পর্কটার? আর নীহার যদি আপত্তি না থাকে, তাহলে ওর পরিবারের আপত্তি থাকার কথা নয়। প্রতিটা বাবা মা চান তারর সন্তান সুখে থাকুক। নীহার পরিবারও নিশ্চয় তার সুখ চান।
শেষদিকে নিহার সাথে রূপনের অনেকবার ঝগড়া হয়েছে এই চাকরি নিয়ে। নীহার পরিবারের এটা পছন্দ, সেটা পছন্দ, রূপনকে এমন হতে হবে, এমনটা হওয়া যাবে না, এটা করা যাবে না আর্র কত কি? পরিবারের বাইরে মানসিক শান্তি খুঁজে পাবার কথা সে মানুষটার কাছে, রূপন তার আচোরণেই অতিষ্ঠ। রূপন কখনো তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে চলত পারে না। বাবা আর নীহার প্রেসারে রূপন আরো একগুয়ে হয়ে উঠছিল। পরিবারের সাথে মনোমালিন্যর জন্যই সে এই কোয়ারেন্টাইনের সময় বাড়িকে যায় নি একথা মোটামুটি নিশ্চিত হতে পেরেছে জামশেদ। আর ঢাকাতে এই বন্দি সময়েও প্রেমিকার সাথে মনোমালিন্য হয়েছে বেশ কয়েকবার।পরিবার আর প্রেমিকার থেকে দূরত্ব তৈরী হয় রূপনের। এটা তার ডিপ্রেশনে থাকার অন্যতম কারণ। এই ডিপ্রেশন থেকেও সে আত্মহত্যা করতে পারে। তবে তাকে হত্যার হুমকি, তার ফেসবুকের পোস্টগুলোও আমলে রাখতে হচ্ছে। সন্দেহ করে নিশ্চিত ভাবে কিছু বলা সম্ভব হবে না। প্রমানাদি আর ক্যালকুলেশন মিলিয়েই রহস্য উদঘাটন করতে হবে।

পুরো রুমটা ভালোভাবে পর্যবেক্ষন করে আলমত খোঁজার চেষ্টা করলো জামশেদ। টেবিলের উপর যে বাটন মোবাইলটা পাওয়া গেছে, সেটা সুইসড অফ অবস্থায় ছিল। মরঝরতর একটা এন্ড্রয়েড মোবাইল ভাঙা অবস্থায় পড়ে আছে। ওটাকেই রূপন ফেসবুক ইউজ করতো হয়ত। ফিঙ্গারপ্রিন্টের জন্য আলামত হিসেবে মোবাইল দুটোই সংগ্রজে নিলো জামশেদ। হাতের ছাপে বোঝা যাবে ফোনটা কে ভেঙেছে। রূপন নাকি অন্যকেউ? টেবিলে সাজানো ছিল মানবজমিন, ক্রাসের কর্ণেল, কেইশ নাম্বার তৈলচিত্র, কাজী হাসান রবিনের সম্ভাবনার স্বপ্নযাত্রা। সেই সাথে কিছু একাডেমিক বই আর খাতা।
খুন কিংবা সুইসাইড সে যেটাই হোক তার আগ পর্যন্ত রূপন এই টেবিলেই বসে ছিল। এবং এই ডায়েরীতেই কিছু লিখছিল। ডায়েরীর সব লেখা মৃত্যুর আগের কি না সেটা বোঝা যাচ্ছে না। তবে ডায়েরীর শেষ লেখাটা একটা ফাকা পেজে "কিছু গল্পের নাম থাকে না" কথাটার মধ্যেই অনেকগুলো গল্প চাপা দিয়ে রেখেছে রূপন। কেউ জানতে পারবে না আর। নিজের সঙ্গী করেই রূপন এই গল্পগুলোই সাথে নিয়ে গেল। তীব্র অভিমানের কথা গুলো সে কাউকে বলতে চায়নি। অথবা বলার মত সময় তাকে দেওয়া হয়নি।
রুমের তালটা গোল তালা। সাবলেটে হলেও তাদের রুমে বাইরে থেকে ঢুকতে আলাদা দরজা ছিল। বাইরের কেউ সেদিন বাসায় এসেছিল কি না সেটা জানতে হবে। যেখানে পুরো এলাকা ফাঁকা, সেখানে রূপন একাই ছিল। এলাকার গলিতে সিসি ক্যামেরা নেই। তাই গলির ভেতরকার সর্বশেষ অবস্থা কেমন ছিল সেটা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। রুমের গোলতালার বিশেষত্ব হল কেউ রুম থেবে বের হলে ভেতর থেকে প্রেস করে বের হলেই রুম লক হয়ে যায়। কিংবা ভেতরের মানুষটাও একইভাবে রুম লক করে রাখে। তবে বাইরে থেকে কেউ আসতে হলে তাকে অবশ্যই চাবি দিয়ে তালা খুলে ঢুকতে হবে, বা ভেতর থেকে খুলে দিতে হবে। রূপনের বাসাকে কেউ এসেছিল কি না, কিংবা রূপন একা ছিল কি না সেটা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায় নি। টহল পুলিশ মহল্লাহ অন্ধকার মানবশূন্য গলির এই বিল্ডিং এর একটা রুম লাইট জ্বলতে দেখে সেখানে আসে। কারণ পুরো মহল্লা যেখানে কদিন ধরেই ফাঁকা, সেখানে এই একটা রুমে লাইট জ্বলাটা পুলিশের কাছে রহস্যজনক মনে হয়েছে।
গলিতে গাড়ি নিয়ে ঢোকার সময় গলি থেকে একজনকে বের হতে দেখেছিল জামশেদ। মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাবস পরা ছিল বলে তাকে ডেকে কোনো প্রশ্ন করেনি জামশেদ। মাস্ক পরার জন্য লোকটার চেহারাটাও ঢাকা ছিল। তবে এখন সেটা অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে।

লেখা পড়ে মনে হচ্ছে শেষ সময়টাতে রূপন খুব মানসিক চাপে ছিল। এই চাপ তাকে জেদী করে তুলেছিল। নাকি মনের কষ্টগুলো লেখার আগেই আতোতায়ের আগমন? কথিত মুক্তির জন্য রূপনের এই আত্মহত্যা নাকি প্রতিবাদী লেখার জন্য পরিকল্পিত খুন??

 

ভালো লাগলে শেয়ার করুন 

শাহরিয়ার সোহাগ এর লেখা বইগুলো সম্পর্কে জানতে বা কিনতে ক্লিক করুন

No comments

Powered by Blogger.