সোহাগনামা || পর্ব - ১৬
২৫
জুন, ২০২৩। মা ঢাকাতে এসেছে হঠাত করে, দুপুর বেলা। যদিও সে আশাটা পরিকল্পিত। ২৬ তারিখ আমার শ্বশুরবাড়ির মানুষদের আমার বাসায় দাওয়াত ছিলো। যদি আমার বাসার এই প্রোগ্রামে আমার মা যশোর থেকে ঢাকাতে চলে আসে তবে প্রোগ্রাম একটা পূর্ণতা পায়। সেজন্যই মাকে নিয়ে আসা। সকালে সব কেনাকাটা শেষ করে দুপুরে মাকে নিয়ে বাসায় এলাম। সন্ধ্যায় মাকে নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে চা খেতে যাওয়ার কথা ছিল। সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। হঠাত আমার কলেজের একটা গ্রুপে রাজ্জাক জানালো আমার প্রিয় বন্ধু রোমান আর নেই। ইটালিতে যেই ফ্যাক্টরিতে সে কাজে গিয়েছিল, সেখানেই একটা মর্মান্তিক দূর্ঘটনায় ঘটনাস্থলে মারা যায় আমার প্রিয় বন্ধু রোমান। মূহুর্তেই যেনো আকাশ ভেঙ্গে পড়লো আমার উপর। আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে পারছিলাম না। সঙ্গে সঙ্গে ফোন দিলাম সবুজকে। সবুজ তো আমার সাথে সে কি রাগ! তার কথা এটা কি সম্ভব নাকি! তারপর এই সংবাদটা সত্য কি মিথ্যা সেটা জানতে বিভিন্ন জায়গায় ফোন দেওয়া শুরু করলাম তবে মনে প্রাণে খুব করে চাচ্ছিলাম ঘটনাটা মিথ্যে হোক। রোমানের কাজিন, রোমানের বউ, রোমানের ফেইসবুক আইডি সব জায়গায় খোজ নিতে শুরু করলাম। এই ঘটনাকে সত্যি প্রমাণ করে রোমান আমি জানার বেশ কয়েক ঘণ্টা আগে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। আমি কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছিনা। আবিদা আর মা দুজন মিলে আমাকে স্বান্তনা দিয়ে যাচ্ছে- যে যাবার সে যাবে, তার জন্য দোয়া করতে হবে, আল্লাহর উপর কারও হাত নেই ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব স্বান্তনা আমি নিজেও বহু মানুষকে বহুবার দিয়েছি কিন্তু কেন জানি রোমানের বেলাতেই এই স্বান্তনা আমার কোনো কাজে আসছেনা। পরদিন আমার বাসায় প্রায় ত্রিশ-পঁয়ত্রিশজনের আয়জন। সেদিকে আমার কোনো চিন্তা নেই। আমার এদিকে কোনো হুশ নেই। আমার স্মৃতিতে তখন কেবলই রোমান। রোমানের সাথে আমার হাজারটা স্মৃতি। এত স্মৃতি এক নিমিষেই কিভাবে আমার স্মৃতিতে চলে এসছে আমি জানিনা। তবে রোমানকে গিয়ে আমার হাজারটা গল্প সবই স্পষ্ট আমার চোখে। মনে হচ্ছে এই তো সেদিনের ঘটনা। ইয়াজুদ্দিন কলেজ, দুজনের একসাথে অসংখ্য আড্ডা। আমি অসুস্থ থাকলে রোমান আমাকে আমার বাসায় দেখতে আসতো, রোমান অসুস্থ থাকলে আমি ওর বাসায় গিয়ে রান্না করে খাওয়াতাম। সম্পর্কটা আমাদের এমনই ছিলো। আমি, রোমান, সবুজ তিনজনের সে কি বন্ধুত্ব! কিছু হলেই আমরা তিনজন জানতামই। আমি কলেজে না গেলে ক্লাস টিচার কিংবা অন্যান্য স্যার ম্যাডাম সবুজ, রোমানের কাছে আমার খবর নিতো। কারণ আমি কোথায় যাই, কি করি না করি সেগুলো কেউ না জানলেও রোমান ঠিকই জানবে। যখন ইয়াজুদ্দিনে পড়তাম তখন এমনও সময় গিয়েছে আমার কাছে টাকা নেই। রোমান কেনো জানি আমাকে দেখলেই বুঝে ফেলতো আমার পকেট আর মনের অবস্থা। আমরা যখন আড্ডা দিতাম আর কিছু খেতাম, রোমান কখনো আমাদের মানিব্যাগ বের করতে দিতো না। সবসময় রোমানই বিল দিতো আগে থেকে। যদিও বা কেউ কখনো আগে বিল দিতে গিয়েছে তবে তার জন্য রোমানের বকা বরাদ্দ।
একটা
ঘটনা শেয়ার করি। এই ঘটনাটা বেশ কয়েকবারই ঘটেছে। আমার মানিব্যাগে ১-১৫০ টাকা আছে মাত্র। পকেটের অবস্থা খুব বেশি ভালোনা। আমরা বন্ধুরা দেখা করবো। রোমান হঠাত এসেই আমাকে বললো তোর মানিব্যাগটা দে। আমি তো দিতে চাইনা। সে জোর করে আমার মানিব্যাগ নিয়ে নিলো এবং সবাইকে ঘোষণা দিয়ে দিলো আজকে সোহাগের মানিব্যাগ থেকে বিল দেওয়া হবে। আর আমি চিন্তায় মাস চালানোর জন্য অবশিষ্ট দেড়শো টাকাই আছে। আমরা বন্ধুরা খাচ্ছি। রোমান অনায়াসেই ৩-৪০০ টাকা বিল দিয়ে দিলো। সবাই জানে সোহাগের মানিব্যাগ থেকে রোমান বিল দিচ্ছে। রোমান যখন আমাকে মানিব্যাগ ফিরিয়ে দেয়, বাসায় আসতে আসতে মানিব্যাগে দেখি কখনো ৫০০ কখনো ১০০০ টাকা। বন্ধুদের সবাই জানতো বিল রোমান দিয়েছে। আসলে রোমান নিজে বিল দিয়ে আমার মানিব্যাগে উল্টো আরও টাকাও দিয়ে দিয়েছে। রোমান কখনো চায়নি বন্ধুদের মধ্যে আমি ছোট হই। রোমান সবসময় আমাকে বড় হতে দেখতে চেয়েছে। রোমান একমাত্র বন্ধু যার মুখ থেকে কখনো কারও জন্য বদনাম শুনিনি, কখনো কোনো গালি শুনিনি, কখনো কোনো খারাপ কথা শুনিনি, খারাপ চিন্তা বুঝিনি। রোমানের সাথে আমার সম্পর্কটা এভাবেই এগুচ্ছিলো। যখন মুন্সীগঞ্জে পড়াশুনা শেষ করে ঢাকাতে ব্যাক করবো, তখনও জানিনা অনার্সে কে কোথায় পড়বো। এটুকু ধারণা ছিলো রোমান বাইরে চলে যাবে। আমি যেদিন মুন্সিগঞ্জ থেকে সবকিছু নিয়ে চলে আসি, রোমান আমাকে বিদায় দিতে এসেছিলো। তখন থেকেই যেহেতু লেখালেখি করি, আমি রোমানকে একটা কলম উপহার দিয়েছিলাম আর বলেছিলাম-‘ আবার কবে দেখা হবে বন্ধু জানিনা তবে আমার এই শেষ স্মৃতিটা তোর কাছে থাক। রোমান বেশ খুশি হয়েছিলো আমার দেওয়া কলম পেয়ে। হুট করে আমি বললাম তুই আমাকে কিছু গিফট দে যেটা বন্ধুর দেওয়া স্মৃতি হয়ে থাকবে। রোমান বেশ কিছুক্ষণ ভেবে কোনোকিছু না পেয়ে ওর দুইটা মোবাইলের একটা মোবাইলের সিম খুলে আমাকে ওর মোবাইলটা দিয়ে দিলো আর বললো- এটা রেখে দে। যখন অনেক বড় লেখক হবি তখনও সাথে এই মোবাইলটা রাখিস। ওই মোবাইলটা এখনো আছে। রোমানের এই করুণ সংবাদ পাওয়ার পর থেকে রোমানেই সেই উপহার দেওয়া মোবাইলটা বারবার দেখছি, হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছি। সেদিন বাসের টিকেট করে দিয়েছিলো রোমান। উল্টো আমাকে জোর করে ১০০ টাকা দিয়ে বললো- ‘পথে খরচ হতে পারে রেখে দে। ২০১৩ সালের ঘটনা এটা। তখন ১০০ টাকার আসলেই দাম ছিলো। আমি যখন অনার্সে ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়ে জিগাতলাতে থাকতাম রোমানও তখন জিগাতলাতে ছিলো। ধানমন্ডির একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিনের জন্য ভর্তি হয়েছিলো। কারণ তখনো ওর ইটালিতে যাওয়ার কাগজ পত্র প্রস্তুত হয়নি। সেখানে ও কখনো এসে আমার বাসায় ঘুমাতো কিংবা আমি মাঝেমাঝে রোমানের বাসায় গিয়ে ঘুমাতাম। আমি রোমান, নাহিদ হাতিরঝিলে ঘুরতে গিয়েছিলাম প্রথমবারের মতো। এরপর রোমান স্থায়ীভাবে ইটালিতে চলে যায়। আমাদের কখনো যোগাযোগ বন্ধ হয়না। ও যখনই দেশে আসে তখনই আমাদের আড্ডা হয়। আমি ঢাকা থেকে মুন্সীগঞ্জে চলে যাই, সবুজ কাজ কর্ম রেখে ফ্রি হয় আমাদের জন্য, রোমানও বন্ধুদের সময় দেয়। রোমান যখন দেশে আসে তখন এভাবে আমাদের দেখা, আড্ডা চলতে থাকে। তাছাড়া দু’জন দু’দেশে থাকা অবস্থাতেও ফোনে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ হয়। রোমান আমাকে প্রথমেই যেটা বলে কথা বলা শুরু করতো- ‘সোহাগ তুই কি ভালো হয়েছিস, নাকি ভালো হবি?’ রোমানের সাথে আমি খুবই ফ্রি ছিলাম। অনেক কথা শেয়ার হতো রোমানের সাথে। আমাকে চেতানোর জন্য আমাদের এক ক্লাসমেট বান্ধবীর কথা জিজ্ঞেস করতো রোমান। আমি ওরে উলটা পাল্টা বকা দিতাম। রোমানকে ঘিরে আমার এমন অনেক অনেক স্মৃতি মূহুর্তেই নাড়া দিচ্ছে মনে। রোমানের গায়ে হলুদ আর বিয়েতে গেছি ১ বছরও হয়নি। ২০২২ সালের ২৮ জুলাই রোমানের বিয়ে হয়। এরপর গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান, বিয়ের অনুষ্ঠান সব খানেই আমি আর আবিদা উপস্থিত থেকেছি। রোমানের কড়া নির্দেশ ছিলো-‘সোহাগ তোকে কিন্তু আসতেই হবে।‘ আবিদা অফিস ছুটি নিয়ে, আমি আমার কাজ রেখে রোমানের গায়ে হলুদে গেছি, শনির আখড়াতে। সেখানে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে ছিলাম। তার কিছুদিন পর মুন্সীগঞ্জে রোমানের বউভাত অনুষ্ঠান হয়, সেখানেও যাই আমরা। সবুজ, রতন মুন্সীগঞ্জ থেকেই আমাদের সাথে জয়েন করে। আমাদের কত কত প্ল্যান ছিলো। বিয়ের পর আমি আমার বউ, রোমান রোমানের বউ আর সবুজ(যেহেতু ও এখনো বিয়ে করেনি) আমরা ৫ জন ঘুরতে যাবো। সবুজ যাবে আমাদের ছবি তুলে দেবার জন্য। আগামী জুলাইয়ে রোমানের দেশে আসার কথা। রোমান আসলেই আমরা সবাই ঘুরতে যাবো। আর জুনের সপ্তাহে ২৫ তারিখে, রোমান আমাদের সবাইকে ফাঁকি দিয়ে মূহুর্তেই কোথায় যেনো হারিয়ে গেলো। ৩ বছর প্রেম করে ভালোবাসার মানুষকে দেওয়া কথা রেখে রোমান তার প্রিয় মানুষটাকে বিয়ে করেছে। এই তো কয়দিন আগের ঘটনা। আর এখন মূহুর্তেই সব শেষ। বছর দেড়েক আগে রোমানের বাবা ইটালিতেই খুন হয়। রোমান ওর নানা বাড়ি, দাদা বাড়ি দুই বংশেরই বড় সন্তান। আদর- ভালোবাসার কোনো কমতি নেই। পুরো গ্রাম কিংবা আমাদের ক্লাসে রোমান ছিলো খুব প্রিয় মানুষ শুধুমাত্র ওর নমনীয় ব্যবহার আর আচার-আচরণের জন্য। এত ভালো একটা মানুষ এত কম বয়সে আমাদের ছেড়ে চলে যাবে। সেটা মানতেই পারছিনা। রোমান বিয়ের জন্য বাংলাদেশে এসেছে আমাকে তা জানায়নি। আমাকে একদিন ভিডিও কল করে বলে কি খবর তোর? কেমন আছিস? ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি বললাম বিয়েটা করে ফেল। এর আগে যতবার ওর সাথে কথা হতো আমি বলতাম বারবার বিয়ের কথা। আমি করে ফেলেছি তুই কেনো করবিনা! করে ফেল। ও হঠাত আমাকে বলে মেয়ে দেখ। আমি বললাম, ‘আচ্ছা ঠিক আছে কেমন মেয়ে পছন্দ ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরা মজা করছিলাম। ও্ হঠাত আমাকে বলে কালকে সন্ধ্যায় শনির আখড়া চলে আসিস আমার গায়ে হলুদ। রোমান বিয়ের জন্য দেশে এসেছে এবং আমাকে সে এভাবেই সারপ্রাইজ দিয়েছে। আমি তো পুরাই অবাক। রোমানের প্রেমের কথাটা জানতাম। তবে বিয়ের ব্যাপারটায় আমি সত্যিই সারপ্রাইজ হয়েছিলাম। বিয়ে নিয়ে রোমানের কত প্ল্যান, কত আয়োজন সবই এক হাতে সামলেছে সে। এসব তো এত দ্রুত ভোলা সম্ভব না। ঘটনাগুলোতো বছর খানেকও পার হয়নি। আমি মুনাকে ফোন দিয়ে ঘটনা চূড়ান্তভাবে শিওর হলাম। এর আগে আর কারও বিদায় আমাকে দুমড়ে মুচড়ে দেয়নি। এর আগে আর কারও বিদায় আমাকে এতটা নিঃস্ব করে যায়নি, আমাকে এতটা শূন্যতায় ডুবায় নি। বারবার খোজ নিতে থাকলাম রোমানকে কখন দেশে আনা হবে। রোমানকে ছুয়ে দেখার যে আক্ষেপ তা আমাকে বারবার পোড়াচ্ছিলো। আমি খুব করে চাচ্ছিলাম রোমানকে অন্তত একবার ছুয়ে দেখি। শুরু হলো রোমানকে দেশে আনার প্রস্তুতি। দেশের বাহিরে থেকে মানুষ এবং ডেডবডি দুটো আসার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। ডেডবডি আসতে অনেক প্রস্তুতির ব্যাপার। রোমান আসার আগেই এই শূণ্যতার মধ্যেই অগোছালোভাবে ২৬ তারিখে আমার বাড়ির প্রোগ্রাম শেষ করি। ২৭ তারিখে মাকে বাসে উঠিয়ে দিয়ে আসি আর তখন আমার ভিতরে রোমানের শূন্যতা ভর করে আছে। আমি প্রতিবার নামাজ পরে রোমানের জন্য দোয়া করি। আমার কোনো কাজ, লেখায় আমি মন দিতে পারছিনা। ৩ তারিখে রোমানের মা আর ছোট ভাই দেশে আসে। ৫ তারিখে রোমানের খালা বাসাতে আন্টি আর রনির সাথে দেখা করতে যাই মুনার সাথে যোগাযোগ করে। আমাকে জড়িয়ে ধরে আন্টির সে কি কান্না! আন্টি আমাকে অকপটে বলতে থাকে রোমান আমাকে ঠিক কতোটা ভালোবাসতো। রোমান সত্যিই আমাকে অনেক বেশিই ভালোবাসতো। কিন্তু কখনো সে তা প্রকাশ করেনি। রোমানের বাসাতে রোমানের কোনো বন্ধুর আগমন এলাউ ছিলোনা। রোমানের বাসাতে কেবল আমিই দিনের পর দিন রাতের পর রাত থেকেছি। একসাথে খাওয়া দাওয়া করেছি, আড্ডা দিয়েছি। রোমানের মাকে বলেছিলো-‘সোহাগের বাসা যশোর। ওর এখানে কেউ নেই। মাঝেমাঝে ও আমার এখানে আসবে। আন্টি কখনো রোমানের কথার দ্বিমত পোষণ করেনি। তাই রোমানের বাসায় আমি অবাধে যাতায়াত করতে পারতাম সেই কলেজের সময় থেকে। রোমানের সাথে আন্টির শেষ স্মৃতি আন্টি আমাকে বলতে থাকেন। পাশে বসে মুনা হাউমাউ করে কাঁদছে। আমার সাথে যাওয়া নাহিদ কিছুক্ষণ পরপর চোখ মুছছে। আন্টি, মুনাকে স্বান্তনা দেবার ভাষা আমার নেই, আমি নিজেই যে ভাষাহীন ভাবে দুমড়ে মুছড়ে যাচ্ছি! আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি রোমানকে দেখার জন্য। মুনার কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম ১০ তারিখ শনিবার রোমানকে দেশে আনা হবে। খুব ভোরে আনা হবে তাই শুক্রবার রাতে ১২ তারিখে আমি মুন্সীগঞ্জ চলে যাই। মাঝরাতে জানতে পারি ট্রানজিট জটিলতার জন্য রোমান এই শনিবারে আসবেনা। রোমানকে আনা হবে আগামী সোমবার। শনিবার সকালে আবার ঢাকাতে চলে আসি আমরা দুজন। রবিবার মাঝরাতে যখন জানতে পারি রোমানকে আনা হচ্ছে সোমবার খুব ভোরে আমি রওনা দিই রোমানের গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে। সেখানে গিয়ে আন্টি এবং মুনার সাথে দেখা করি। খুব অবাক হই ওর কাজিন, অন্যান্য বন্ধু-বান্ধবেরাও আমাকে চেনে। রোমান তাদেরকে তার সোহাগ বন্ধুর গল্প বলেছেন অনেক। রোমানের আট’টার মধ্যেই চলে আসার কথা ছিলো। এয়ারপোর্টের আনুষ্ঠানিকতা, জটিলতা সব কাটিয়ে রোমানের আসতে সময় লাগে বেলা সাড়ে ১১ টা। সকাল থেকে আকাশটা বেশ গম্ভীর হয়ে ছিলো, যেকোনো মূহুর্তেই আকাশ অন্ধকার করে বঋষ্টি নামার অপেক্ষা। ততক্ষণে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছে, আমরা সবাই অপেক্ষা করছিলাম রোমানকে বহনকারী ফ্রিজিং ভ্যানের জন্য। বৃষ্টি আর বাতাসের সে কি এক ভারী শব্দ, সেই ভারী শব্দ ভেদ করে ফ্রিজিং ভ্যানের সাইরেনের শব্দ শুনতে পাই আমরা। এই তো, রোমান এসে গেছে। এর আগে আমাদের বহু বার রোমানের বাড়িতে যাবার কথা ছিলো। সময়, ব্যস্ততার কারনে তা হয়ে উঠেনি। আর আজ রোমানকে দেখার জন্য সব কাজ ফেলে অনেক দূরদূরান্ত থেকে আমরা এসেছি। ঠিক যখনই দূর থেকে ফ্রিজিং ভ্যানটি আমার চোখে দৃশ্যমান, তখনই আকাশ জুড়ে সে কি বৃষ্টি! এই বৃষ্টি আমাকে ছুয়ে দেয়না, এই বৃষ্টি আমাকে মুগ্ধতায় ভাসায় না, এই বৃষ্টি আমার চোখের পানি লুকাতে সাহায্য করে কেবল। রোমানের সাথে আমার দূরত্ব এক হাতেরও কম। তবে কেন জানি দূরত্বটা যোজন-যোজনের। বৃষ্টির মধ্যে রোমানকে বের করা সম্ভব হচ্ছিলোনা। বৃষ্টির মধ্যে আমি,রাজ্জাক, রতন, সবুজ, রোমানের এক খালাতো ভাই সোহাগ আমরা সবাই মিলে ওদের গ্রামের মসজিদ থেকে খাটিয়া আনি রোমানকে উঠাবো বলে। আমরা বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু বৃষ্টি থামেনা। কখনো বাড়ে, কখনো বা কমে। এই অবস্থার মধ্যে থেকেই ফ্রিজিং ভ্যান থেকে রোমানের কফিন বের করা হয়। এরপর কফিন থেকে একে একে তিন ইঞ্চি স্ক্রু খোলা হয়। এভাবে বদ্ধ আছে রোমান! এটা কি করে মানবো! কিছুক্ষণ পরপর সেখানে আন্টি আসে, মুনা আসে। তাদের কান্না থামানোর মতো শক্তি, সাহস কোনোটাই আমার নেই। আন্টি বারবার আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে রোমানকে শেষবারের মতো দেখতে চাই। এদিকে সিদ্ধান্ত হয়েছে রোমানের মুখ দেখানো হবেনা। অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনায় রোমান অনেকটা বিধ্বস্ত। গায়ের উপর ভারী মেশিন পড়াতে রোমান ক্ষত-বিক্ষত। যে ক্ষত-বিক্ষত মুখ দেখার সাহস আমাদের কারোরই হচ্ছিলোনা। আমি আন্টির কথা রাখতে পারিনি। সব নাট খুলে রোমানের খাটিয়া নিয়ে আমরা যাই নির্মানাধীন একটি মসজিদে। রোমানের জানাযা দিতে হবে কিন্তু তখনও প্রচণ্ড বৃষ্টি। সব নাট খুলে উপরিভাগ তুলতেই ভিতরে এলুমিনিয়ামের আরেকটি সিল গালা বাক্স। হাতুড়ি-শ্রেনী দিয়ে সেই বক্স কাটা হলো। তার ভিতরে বদ্ধ ছিলো আমার বন্ধু রোমান। জানাযা হলো, তারপর রোমানকে নিয়ে যাওয়া হলো চিতলিয়া দেওয়ানগান্ধী গ্রামের কবরস্থানে। সেখানে রোমানের অন্তিম যাত্রার জন্য কবর খোড়া হয়েছে। এর আগে কবর যেনো সুরক্ষিত থাকে তাই আমরা বন্ধুরয়া মিলে পলিথিন, টিন দিয়ে কবর ঢেকে গিয়েছিলাম। সব টিন সরানো হলো এবার রোমানকে নামানোর পালা। হাজার মানুষের কান্না, আহাজারিতে গোরস্থান ভারী হয়ে গেছে। সবাই স্তব্ধ। রোমানকে নামানোর জন্য কবরে নামতে হবে দুজনকে। রোমানের এক মামার সাথে আমি নামলাম রোমানকে শেষবারের মতো ছুয়ে দেখার আক্ষেপটা ঘুচানোর জন্য। রোমানের মুখের দিকে না দাড়িয়ে আমি পায়ের দিকে দাড়িয়েছিলাম কারণ রোমানের মুখের দিকে তাকানোর সাহস আমার নেই। আমার স্মৃতিতে শুধু রোমানের হাসিমাখা চেহারাটাই ভেসে উঠছিলো। রোমানকে ধরে নামানো হলো। রোমানের পা, হাটু আর কোমরের বাধন খুলে দিলাম আমি। সোজা করে শুইয়ে দিলাম। তারপর একে একে বাশ দিয়ে রোমানের অন্তিম যাত্রার ঘরটা প্রস্তুত করা হচ্ছে। তারপর মাটি দিলাম আমরা। আন্টি আর মুনার হাতে মাটি দিলাম আমরা। তারা মাটি ছিটিয়ে দিলো রোমানের কবরে। আমার গায়ে ভেজা জিন্স আর পাঞ্জাবী। সেদিকে আমার কোনো নজর ছিলোনা। আমার ধ্যান-জ্ঞান, চিন্তা, স্মৃতিতে শুধুই আমার বন্ধু রোমান। রোমানকে বিদায় দিয়ে মনাজাত শেষ করে সেই ভেজা শরীরে ঢাকার পথে রওনা হলাম আমি। তার দুইদিন পর মনা জানালো রোমানের মিলাদ হবে আগামী বৃহস্পতিবার। আন্টি যেতে বলেছেন। এই বয়সে রোমানের মিলাদে অংশ নিবো সেটা কখনো ভাবিনি। এই মিলাদের খাবার আমার গলা দিয়ে যে নামবেনা সেটা আমি জানি। আমি আন্টিকে দেখার জন্যেই যাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। আবিদা বললো সেও আমার সাথে যেতে চায়। অফিস ছুটি নিয়ে বৃহস্পতিবার সকালে আবিদা আমার সাথে রোমানের গ্রামের বাড়ির উদ্দ্যেশ্যে রওনা হলো। রোমানের কবর জিয়ারত করে, আন্টির সাথে দেখা করে আন্টিকে স্বান্তনা দেবার চেষ্টা করলাম। মায়ের মনে এসব স্বান্তনা কোনো কাজে দেয়না। রোমানের বিয়ে হয়েছিলো বৃহস্পতিবার। আর রোমান মারাও গিয়েছিলো বৃহস্পতিবারে। রোমানের জন্ম, রোমানের দাফন এবং রোমানের মিলাদ কাকতালীয়ভাবে এসব কিছুই সোমবারে হয়েছে। ১৫ জুন ২০২৩, রোমান আর মনার প্রেমের ৪ বছর পূর্ণ হলো। ঠিক এই ১৫ জুন রোমানের দাফনের ৪ দিন হওয়াতে রোমানের বাড়িতে মিলাদের আয়োজন করা হয়েছে। আমাদের জীবনটা খুব অদ্ভুত, আমাদের জীবনটা কিছু বার আর কিছু সংখ্যার মধ্যে আটকে থাকে সবসময়। এটা কপালের লিখন বলে অস্বীকার করা যায়না, অবাধ্যও হওয়া যায়না। আমি যখন রোমানের কবর জিয়ারত করতে যাই তখন বারবার মনে হচ্ছিলো এটা রোমানের না এটা অন্য কারও কবর। আর রোমান হঠাত এসে আমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলবে কি রে বেটা! আমার গ্রামের বাড়িতে আসলি কিন্তু আমাকে জানিয়ে আসবি না! আমার মনের এক কোনে এখনো সেই বিশ্বাস লেগে আছে রোমানের কিচ্ছু হয়নি! রোমানের সাথে আবার দেখা হবে। ঠিক এই বিশ্বাসের জন্যেই রোমানের শেষ বিদায়ের মুখটা আমি দেখার সাহস পাইনি। তাহলে আমার এই বিশ্বাসটা ভেঙ্গে যাবে। আমার বন্ধু রোমান যেখানেই থাক ও ভালো থাক। রোমানের মতো ভালো মানুষ আমি দেখিনি, আর দেখবো কিনা জানিনা। আমার জীবনে রোমানের মতো মানুষের জায়গা সারাজীবনের জন্য অপূর্ণ থেকে যাবে। রোমানের বিকল্প আসা সম্ভব না।
No comments