Header Ads

সোহাগনামা || পর্ব - ১৪

 

Shahriar Sohag, শাহরিয়ার সোহাগ, sohagnama, সোহাগনামা ১৪

জুলাই রাতে আমি আর আবিদা আমাদের নতুন বাসার মালিক জনাব আব্দুল মালেক মোল্লা স্যারের বাসাতে যাই উনাকে দাওয়াত দিতে। উনি সচারচর বোনো দাওয়াতে যান না, তবে যেহেতু তার বাড়িতে আছি, আর প্রোগ্রাসে এত এত মানুষ আসবে তাই, দাওয়াত দিয়ে উনাকে এই জমায়েতের কথা জানান দেওয়া আর কি। তবে উনি আমাদের অনুষ্ঠানে আসলে আমরা দুজনই যে খুব খুশি হবো তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মালেক স্যার আমার পারিবারিক অবস্থা আর আবিদার বাবা, চাচার আচোরণ সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। তবে উনি দাওয়াত পেয়ে বললেন আমাদের পারিবারিক অনুষ্ঠানে তার যাওয়া ঠিক হবে না। আমি উনাকে বললাম তিনি আমার গার্ডিয়ান, এখন এখানে আমার কেউ নেই। করোনার জন্য মা আসতে পারছেন না। তাই আমি চাই উনাকে নিয়ে যেতে। আর আমার শশুরের এসআই, ওসির গালগল্পও উনি জানেন। সব শুনে স্যার বললেন উনি যতি যান তবে জন যাবেন। স্যার, উনার সহধর্মিণী, এক নাতনি, এক পালক মেয়ে। আমিও কোনো কিছু না ভেবে রাজি হয়ে যাই। তার মত বড় মাপের মানুষ আমার প্রোগ্রামে আসবেন, এই সুযোগ তো আর হাতছাড়া করতে পারি না। তবে আমার ভাগ্যে যে কার চেয়েও বড় কিছু ছিল আমি ভাবিনি। তখন মোটামুটি রাত দশটার বেশি। পরদিন আমাদের প্রোগ্রাম। স্যার এবার নিজেই সব দায়িত্ব নেওয়া শুরু করলেন। তার বাড়ি থেকে বর যাবে গাড়িতে। পাশাপাশি দুইটা বিল্ডিং। তবে স্যারের কথা হল স্যারের বাসা থেকে বর গাড়িতে গিয়ে গাড়িতে বউ আনবে। স্যার তার গাড়ি ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে দিলেন। এবার উঠলো বউ কি পরবে? আমি বললাম মা যেহেতু এখন আসতে পারবে না, তাই আমি তাকে লাগেজ দিচ্ছি না। স্যার তার বাড়ির শাড়ি, গহনা বের করে আকিদাকে বললে পছন্দ করে নিতে। সবকিছু যেন স্বপ্নের মত লাগছিল। যদিও শেষমেষ লাগেজ থেকে একটা শাড়ি দিয়েছিলাম আবিদাকে। প্রোগ্রামের জন্য আবিদার পার্লার খরচও স্যার দিয়ে দিয়েছিলেন। তার একটাই কথা, স্যারের বাড়িতে বউ আসবে, বউয়ের মত করেই আসতে হবে।

আমার শশুর প্রোগামে মালেক স্যারের যাওয়ার ব্যাপারে অবগত ছিলেন। রাতে তিনি বাসার সবাইকে নিয়ে কথা বলার সময় বললেন - আরেক সেদিন তো মালেক ভাইয়ের সাথে দেখা। মালেক ভাই তো আমাকে দেখেই বলে যে আরে আজিজ সাহেব, আপনিই তাহলে সেই আজিজ সাহেব, আপনার গল্প শুনতে শুনতে তো কান নষ্ট হয়ে গেলো।' আমার শশুর চাপাটা একটু বেশিই মেরেছিলেন। রাত পোহাতেই প্রমাণও পেলাম।

জুলাই শুক্রবার আবিদা স্যারের গাড়িতে পার্লারে গেলো। আমরা মোটামুটি সবাই রেডি, তবে অনুষ্ঠানের মধ্যমনি আমার বউ তখনো পার্লার থেকে আসেনি। তাই আমরাও রওনা হতে পারছি না। স্যার আবিদাকে পার্লার থেকে আনার জন্য গাড়ি পাঠালেন।

স্যারকে নিয়ে আমরা বরযাত্রী রেডি। আমি, মইন মামা, লাকি মামী, মামাতো ভাই মুনায়েম আর মাইমুন, স্যারের বাড়ির চারজন, আর আবিদার বোন নাইমা, আনিকা, মামাতো বোন শেফা তো আগেই বলে রেখেছিল তারা বরযাত্রী। বরযাত্রী নিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম আমার শশুরবাড়ি পাশের বিল্ডিং এ। তলা বিল্ডিং এর ১৬ টা ফ্লাটের একটা আমার শশুরের।

একটা রুমে আমাদের বসিয়ে শরবত দেওয়া হলো। তারপর সরাসরি খাওয়ার টেবিলে। স্যারকে পার্সোনালি খেতে বসাতে চেয়েছিলাম, তবে স্যার বললে তিনি সবার সাথে বসেই খাবেন। ওহ হ্যা, মালেক স্যারকে আমার শশুরও তখন স্যার বলে ডাকছিল। পুরোটা সময় তিনি মালেক স্যারকে স্যার ছাড়া ডাকেননি। গতরাতে তার গল্পের কথা ভেবে হাসি যেত আমার থামে না। এর মধ্যে স্যারে আমার পরিচয় দিতে অস্বীকৃতি জানানো আমার ফটোস্টাট চাচাশশুরকে দেখতে চেয়েছিলেন। তবে ভদ্রলোক আসেননি। আমাকে নিয়ে আয়োজনে সে আসবে! তার এত সময় নষ্ট করার সময় কই?

বাসায় আয়তনের তুলনায় অনেক বেশি মানুষ হওয়াতে খাওয়ার পর কিছুক্ষণ বসে স্যার সবার থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় চলে আসেন।

আবিদার বাসা থেকে বিদায় নেওয়ার সময় কথা বলার জন্য সবাই এক রুমে বসলাম। আবিদাকে চেয়ার দিয়ে মাঝে বসানো হল। মামা মামী মায়ের পক্ষ থেকে আপাতত দেড় ভরী গহনা দিয়ে আবিদাকে নিয়ে আসবে। আমার শশুরের আগের মন্তব্য সম্পর্কে মামা মামী সব জানেন। মামা গহনা বের করলে মামী আবিদাকে গলার হার পরিয়ে দিচ্ছিলেন। মামা তখন গহনার বাক্সটা দেন আমার শশুরের হাতে। আমার শশুর তখন গহনার বাক্সের অবশিষ্ট গহনা কানের দুল হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছিলাম। এক সময় সবার চোখ ফাকি দিয়ে কানের দুলের পেছনের হলমার্কটা দেখে নিলেন কত ক্যারটের গোল্ড দিয়েছি, আদৌ গোল্ড দিয়েছি কি না। তবে তার চোখ যখন গহনার হলমার্কের দিকে, সেই রুমের আরো অনেকজোড়া চোখ তখন আমার শশুরের এমন কৌতূহলী আচোরণের দিকে। সত্যিই, দারুন বুদ্ধিমান একটা শশুর পেয়েছি আমি। গহনার পর্ব শেষ। শেষ কথা বলার মামা যখন আমাদের কথা বলছিলেন তখন আমার শশুর প্রসঙ্গ বদলাতে হঠাৎ উপস্থিত সবাইকে প্রশ্ন করলেন করোনা রোগ কিভাবে ছড়াই। সত্যিই, আজব মানুষ তিনি।

আবিদাকে নিয়ে যখন আমরা সবাই চলে আসবো, তখন আবিদার বাসার সবাই বললো তারা আবিদাকে আমার বাসায় রেখে আসতে যাবে। এমন কিছু হতে পারে সেটা আগেই ভেবেছিলাম, কারণ বাসা তো পাশাপাশি। তাই আবিদার বন্ধু মোশাররফকে দিয়ে মিষ্টি, আম আনিয়েছিলাম। অন্যান্য নাস্তা আমি আগেই এনে রেখেছিলাম। মোশাররফ আবিদার কোচিং এর ফ্রেন্ড। তবে আমার সাথেও বেশ বন্ধু সুলভ সম্পর্ক। অনুষ্ঠানে আবিদার বাসাতে ওকে নিয়ে যায় নি। কারণ আমার শশুর আবার বেশি মানুষ এলাও করেন নি। এসব নাস্তা দিয়েই কন্যপক্ষদের আপ্যায়ন করলেন লাকি মামী। আমার শশুর এই প্রথম আমার বাসায় আসলেন। বাসায় ঢুকেই বাচ্চাদের মত পুরো বাসা যেন দৌড়ে বেড়িয়ে দেখছেন বাসায় কি কি আছে। দুদিন আগে কেনা খাট দেখলেন, ওয়ারড্রবের ড্রয়ার খুলে খুলে দেখলেন। কবে কি কি যে দেখলেন সেটা উনি আর উনার আল্লাহ ভালো বলতে পারবেন। আমার আপ্যায়নে উনাদের আচোরণে মনে হল তারা সন্তুষ্ট। তবে এর মধ্যেও আমি নিজ কানে শুনলাম আমার শশুর মইন মামাকে বলছেন - "এসব তো সোহাগ ওর মায়ের টাকায় করছে। সোহাগের কোনো ইনকাম আছে নাকি! সোহাগ টাকা পাবে কোথায়।" বাড়ি ভর্তি অনেক মানুষ। একমাত্র শশুরের এমন আচোরণ হজম করে আপ্যায়নে মনোযোগী হলাম। আমার শশুর হঠাৎ বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। এরপর মইন মামাকে কল দিয়ে জানালেন তারাও তো আমার জন্য অনেককিছু কিনেছে। আপাতত আংটিটা দিতে চায়। এই কথার দুইটা অর্থ পেয়েছি আমি। ২১ ক্যারেটের দেড় ভরি গহনা দেখতে দেখতে আমার শশুর বুলে গিয়েছিল আমাকে আংটি দেওয়া উচিৎ। অথবা আমার শশুর গিভ এন্ড টেকে বিশ্বাসী। আমি কিছু না দিলে তিনিও দিতেন না। আমি দিয়েছি বলে পরে ভেবে চিন্তে তিনিও দিলেন। সত্যিই তিনি অনেক বুদ্ধিমান। আমার শশুর আমাকে পছন্দ করেন না। এটা আমি জানি। আর তার একটাই কারণ উনি তো আমাকে নিয়ে গল্প করতে পারেন না। কারণ তার চোখে আমি বেকার, বিয়ে পাশ, দুকলম লেখালেখি করি। উল্লেখ্য ঠিক এই ঘটনার সময় আমার প্রকাশিত বই সংখ্যা আমার শশুর আমাকে হলোমার্ক ছাড়া একটা আংটি দেন। পকেটে করে আংটি এনে আমার বাসাতে আংটি পরানো হলো। আংটি পরার পর সবার দেখতে থাকলো এটা কেমন আংটি, মাঝখানে বিশাল বড় একটা পাথর। পাশ থেকেকে আবিদার নানু বললেন - ছেলেদের তো স্বর্ণ পরা হারাম। তাই ছোট করে দিছে। তার কথাতে মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। আমি উত্তর দিলাম স্বর্ণ পরা হারাম, তবে ডায়মন্ড পরা যায় তো। তাহলে ডায়মন্ডের আংটি দিতেন একটু বড় করে।

তারিখ রাতে স্কুল বন্ধু সুজন আর নাসির এসেছিল আমাকে অভিনন্দন জানাতে।

১০ তারিখ বিকালের ঘটনা। আমি তখন আমার প্রোজেক্টের কাজ করছি। আবিদা কিছুক্ষণ আগে লাঞ্চ করেছে। আমার শরীর খারাপ লাগছে বলে আমি তখনো কিছু খাইনি। নাইমা আবিদাকে কল করে জানালো আম্মু নাকি কাঁদতেছে। এটা বলেই নাইমাও কাঁদতেছিল। আবিদা আমাকে জানাতেই আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম গুছিয়ে নেও, তোমার বাসাতে যাবে। তখন সময় সাড়ে তিনটা। আমার সাত তলা থেকে নেমে ওদের তলাতে উঠতে হবে। তারপরও এখন যেতে হবে। গিয়ে দেখি খাবার টেবিলে বসে আমার শাশুড়ি, নাইমা, আনিকা, শেফা, নানু সবাই কাঁদতেছে। আমি আম্মুর মাথা আমার সাথে চেপে মাথায় হাত বুলিয়ে তার কান্না থামানোর চেষ্টা করলাম। আবিদাকে বললাম খাবার নিয়ে আম্মুর পাশে বসতে। আবিদা একটা মাছ নিয়ে আম্মুর পাশে বসলো। আমি আরেকটা চেয়ারে বসে সবাইকে সঙ্গ দিচ্ছিলাম। প্রতিদিনের মত দুপুরে খাওয়ার সময়, খাবার বাড়তে গিয়ে আবিদার চেয়ার ফাঁকা দেখে আপ্লুত হয়ে গিয়েছিলেন আমার শাশুড়ি। মায়ের মন তো, মেয়ের জন্য কাঁদাটা স্বাভাবিক। তবে তখন আবিদাকে নিয়ে যাওয়াতে আম্মু খুশি হয়েছিলেন হয়তো।



ভালো লাগলে শেয়ার করুন 

শাহরিয়ার সোহাগ এর লেখা বইগুলো সম্পর্কে জানতে বা কিনতে ক্লিক করুন

No comments

Powered by Blogger.