Header Ads

সোহাগনামা || পর্ব - ১১

 

Shahriar Sohag, শাহরিয়ার সোহাগ, sohagnama, সোহাগনামা ১১


আমি এখন যার কথা বলছি তার নাম তোমার প্রমা দাস। প্রদীপ দার ছোট বোন। মুন্সিগঞ্জ থিয়েটার সার্কেলে প্রদীপ দা ছিল আমার মঞ্চের সহকর্মী।

প্রদীপ একজন ভালো মিউজিশিয়ানও বটে। আমার প্রথম বই ছিলো অসমাপ্ত বন্ধুত্ব। প্রদীপ দা আমার একটা বইও কিনলো আমাকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য। বইয়ে প্রদীপ দার নামে একটা অটোগ্রাফ দিয়েছিলাম। মুন্সিগঞ্জ শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গনে বই মেলা হচ্ছিলো। স্টলে কখনো মাহিন থাকতো কখনো আকাশ থাকতো। ওই সময়টাতে কেউ ছিলনা। আমি একা বসেছিলাম স্টলে। হঠাৎ প্রমা আসলো। বই দেখতে দেখতে অসমাপ্ত বন্ধুত্ব বইটা হাতে নিলো। স্বভাবতই একজন পাঠক এসে যখন আমার বইটা হাতে নিয়ে দেখে আমি একটু বেশি বিনয়ী হয়ে উঠি। প্রমা তখনও জানেনা বইটার লেখক আমি নিজে। অবশ্য প্রমারও দোষ না। আমার তখনকার চেহারা আর লেখক পরিচিতি তে দেওয়া আমার ছবি দুইটির মধ্যে বেশ অমিল ছিল। প্রমা আমাকে জিজ্ঞেস করলো অসমাপ্ত বন্ধুত্ব বইটির লেখক কে আমি চিনি কিনা। আমি কেন জানি পরিচয় গোপন করে বললাম - হ্যাঁ বইটার লেখক আমার পরিচিত। প্রমা তখন আমাকে বললো আমি যেন তার হয়ে লেখককে খুব করে বকে দিই। বইটাতে এমন পরিণতির জন্য বইটার লেখক কে নিয়ে তার অনেক অভিযোগ। লেখক কেন এটা করেছে, সেটা করেছে, শেষটা কেন এমন করেছে, ওকে কেন মেরে ফেলেছে ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। একপর্যায়ে প্রমার অভিযোগের পাল্লা সহ্য করতে না পেরে আমি পরিচয় দিলাম আমি বইটির লেখক। হঠাৎ আমাকে দেখে যেন প্রমা এক লাফে আকাশে উঠে গেল। প্রমা তো আমাকে তো সরি টরি বলে একাকার অবস্থা। সে বেশি বলে ফেলেছে, বেশি এক্সাইটেড হয়ে গেছিল, এজন্য এত এত বকাঝকা করেছে আমাকে, তবে আমি খুব স্বাভাবিক ভাবেই নিলাম। আমি তাকে বললাম যে আমি কিছু মনে করিনি। আমার ভালোই লেগেছে একজন পাঠক এর থেকে আমি সরাসরি আমার বইটা সম্পর্কে মন্তব্য জানতে পেরেছি। থ্রিপিস পরা, চুল সুন্দর করে আঁচড়ানে, অতি ভদ্র চাহনীর একটা মেয়ে প্রমা। ওর সাথে ওর একটা বান্ধবী ছিল আর আমি হেংলা পাতলা চশমা পরা একটা ছেলে জিন্স আর শার্ট পরা। ওটা ছিল প্রমার সাথে আমার প্রথম দেখা। আমার প্রথম বই হওয়াতে বইয়ে আমার ফোন নাম্বারটাও ছিলো। কারণ প্রথম বই, আমার লেখা সম্পর্কে পাঠকের কি মন্তব্য হতে পারে, সেসব জানার জন্যই সরাসরি ফোন নাম্বারটা দিয়েছিলাম। সেটা ভাল হয়েছিল নাকি খারাপ হয়েছিল বলবো না, আমি জানিও না। তবে ওখান থেকেই প্রমা আমার নাম্বারটা পেয়েছিল। মেলা শেষে রাতেরবেলা বাসায় ফিরলাম হঠাৎ আমার একটা মেসেজ আসলো গুড নাইট। আমি প্রমা। তারপর তো আমাদের ফোনে কথা বলা শুরু হল। প্রমা আমাকে সুন্দর একটা নাম দিয়েছিল। খারাপ মানুষ। কারন আমি আমার গল্পে মিল করতে পারিনা। গল্পের চরিত্রগুলোকে খুব খুব খুব কষ্ট দিই। এবং তার জন্য আমার পাঠকরাও খুব কষ্ট পাই। তো সব মিলিয়ে আমি একটা খারাপ মানুষ। প্রমা আমাকে এই নামে ডাকতো। প্রমার সাথে আমার একটা খুব ভালো বন্ধুত্ব তৈরি হয়। প্রমা আমার থেকে বছর দুয়েক ছোট হবে। প্রমা আর আমার বন্ধুত্বটা খুব কম সময়ে হওয়ার অন্যতম একটা কারণ সে প্রদ্বীপ দার ছোট বোন। কারণ প্রদ্বীপ দা কে আমি আগে থেকেই চিনি। তবে আমাদের বন্ধুত্বের কথা প্রদ্বীপ দা হয়তো জানতো না। ফোনে আমাদের নিয়মিত গল্প আর আড্ডা দেওয়া শুরু হয়। তখন আমি ঢাকাতে থাকি। আর প্রমা মুন্সীগঞ্জে পড়াশোনা করে। আমাদের আড্ডা ফোন নির্ভর ছিল। আমি প্রমাকে যতটা না খোঁজ নিতাম তার থেকে প্রমা আমার বেশি খোঁজ নিতো। প্রমা এই খোঁজ নেওয়া এক পর্যায়ে ভালোবাসা তে রূপ নিয়েছিল। আমার প্রতি প্রমার ভালোবাসাটা ছিলো অন্ধের মত। তবে তখন আমার এই ছোট্ট মাথায় অনেক কিছুই ভাবতে হত। দুই ধর্মের দুটো মানুষের পরিবার কিভাবে নেবে, তারা কেমন থাকবে, আত্মীয় স্বজন প্রতিবেশি কিংবা পারিপার্শ্বিক অবস্থা সবকিছু মিলিয়ে আমার মন কখনো এমন প্রেমে সম্মতি দিত না। তবে দিন দিন প্রমার ভালোবাসা বাড়তেই থাকে। দিনে দিনে আমি হয়ে যাই প্রমার ভালোবাসা। আর প্রমা হয়ে যায় আমার অভ্যাস। পশ্চিমবাংলার একটা সাহিত্য পত্রিকাতে আমার লেখা ছাপা হয়। সেটা ওপার বাংলাতে কোন পত্রিকাতে আমার লেখা প্রথম ছাপানো। ওই সুযোগটা প্রমার মাধ্যমে হয়েছিল। প্রমা ওখানকার একজন ব্যক্তি অসিত কুমার মন্ডল এর মাধ্যমে ওপার বাংলার একটি সাহিত্য পত্রিকাতে আমার লেখা ছাপানোর ব্যবস্থা করে। সেজন্য প্রমার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। প্রমাও বেশ ভালই লিখতো। এখন লেখালিখিটা করে কিনা আমি ঠিক জানিনা। কারণ যোগাযোগটা অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে আমাদের। প্রমার বাবা খুব অসুস্থ ছিল। তার জন্য প্রমাকে বিয়ে দেয়ার জন্য খুব তোড়জোড় ছিল তার বাড়িতে। আর প্রমা চাচ্ছিলো আমি যেন তাকে বিয়ে করি। তখন আমি কেবল অনার্স ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র। আমার পক্ষে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে সঠিক মনে হচ্ছিল না। দুইজন দুই ধর্মের, আমি বেকার আমরা দুজনই পরিবারের প্রতি নির্ভরশীল এবং পরিবারের একটা গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। সবকিছু মিলে আমি চাইনি এগোতে। প্রমা ভেবেছে আমি ভীতু, আমি স্বার্থপর, আমি সুবিধাবাদী। অবশ্য তার ভাবার যথেষ্ট কারণও ছিল। ওর বাসা থেকে বিয়ের কথা যখন এগোতে থাকে প্রমা অনেকবারই পালিয়ে আসতে চেয়েছিল। আমি তখন ইচ্ছে করেই প্রমার সাথে খারাপ ব্যবহার করতামকারণ আমি কোনভাবেই বোঝাতে পারছিলাম না। আমার জীবনে আমি হয়তো কখনো কারো সাথে এতটা খারাপ ব্যবহার করিনি, হয়তো করবোও না। ঠিক যতটা খারাপ কথা প্রমা সহ্য করেছে। আমি তো বলবো সেই ১৮ বছর বয়সে প্রমার সবচেয়ে ভুল সিদ্ধান্ত ছিলাম আমি। প্রমার সেই যৌবনদীপ্ত বয়সে আমি ছিলাম একটা ভুল মানুষ। আমি যাচ্ছেতাই ভাবে প্রমাকে বলতাম আর প্রমা মুখ বুঝে আমাকে সহ্য করতো। ও শুধু চাইতো আমি যেন সব ঠিকঠাকভাবে নিয়ে নিই। তবে আমার পক্ষে সেটা সম্ভব হচ্ছিল না। হয়তো বা আমার সেই সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। আমি চেয়েছিলাম আমার এই খারাপ ব্যবহারের দরুন প্রমার মনে আমার জন্য ঘৃণা জন্মাক। প্রমা আমার থেকে দূরে সরে যাক। প্রমা তার পরিবার নিয়ে ভালো থাকুক। প্রমা ওর নিজের মতো করে ভালো থাকুকআমার এই চাওয়াটা সত্যি হয়েছে। যে যার মতো করে ভালো আছে। তবে আমি এখনো প্রমার চোখে একটা খারাপ মানুষ হয়ে আছি। পরিচয়ের শুরুতে খারাপ মানুষ নামটা ছিল আদরের ডাক। আর এখনকার খারাপ মানুষটা তীব্র ঘৃণার। তবে তাতে আমার কোন ক্ষোভ নেই কোনো অভিযোগ নেই। সে ভাল থাক। শুনেছি প্রমার বেশ ভালো একটা ঘরে বিয়ে হয়েছে। স্বামী তাকে যথেষ্ঠ ভালোবাসে। তাদের ঘরে ফুটফুটে একটা বাচ্চা হয়েছে। প্রমা আমার প্রাক্তন না, একটা ভালো বন্ধু, একটা সুন্দর অভ্যাস। যেগুলো এখন কিছুই নেই। কিছু মানুষকে ভালো রাখার জন্য কখনো কখনো নিজে থেকেই খারাপ হতে হয়নিজে থেকেই দূরত্ব নিয়ে দূরে চলে আসতে হয়। তখনকার সেই সময়টাতে আমিও ঠিক সেটাই করেছিলাম।

 

ভালো লাগলে শেয়ার করুন 

শাহরিয়ার সোহাগ এর লেখা বইগুলো সম্পর্কে জানতে বা কিনতে ক্লিক করুন

No comments

Powered by Blogger.