Header Ads

সোহাগনামা || পর্ব - ৯

 

Shahriar Sohag, শাহরিয়ার সোহাগ, sohagnama, সোহাগনামা ৯

আমি রাগ করেছি এটা যেমন রিমু বিশ্বাস করতো না। তেমনি আমিও বিশ্বাস করতে পারতাম না রিমু আমার উপরে রাগ করে আছে। আমাদের অসংখ্য স্মৃতি থাকলেও কিছু কিছু স্মৃতি আছে যেগুলো ভোলার না। ২০১২ সালের ডিসেম্বরের ১২ তারিখ রাত বারোটা রারো তে আমি রিমুর সাথে ১২ মিনিট ১২ সেকেন্ড কথা বলি। ওই রাতে আমি ওকে ফ্রেন্ডশীপ উইশ করেছিলাম। ঐদিন বেলা ১২ টা ১২ মিনিট ১২ সেকেন্ডে আমি আবারো উইশ করি রিমুকে। তখনো কথা হয় ১২ মিনিট ১২ সেকেন্ড। পৃথিবীতে আমাদের মত অনেক বন্ধু আসবে যাবে। তারা এই পৃথিবীর বুকে নিজেদের বন্ধুত্বকে স্মরণীয় করে রাখতে চাইবে বিভিন্নভাবে। তবে আমরা এমন একটা সময় কে স্মরণীয় করতে পেরেছি যা আগামী একশো বছরেও কারো দ্বারা আর হয়তো সম্ভব হবে না। মাঝে মাঝে আমি রিমুকে গিফট দিতাম। তবে আমার সে জিনিসগুলোকে গিফট বললে গিফটেরও অপমান করা হবে। কারন আমি রিমুকে যা দিতাম তার সবই ছিল আমার ব্যবহৃত জিনিসের ভিন্নরূপে উপস্থাপনের মাধ্যমে আমারই বানানো কোন জিনিস। টাকার অভাবে আমি গিফট কিনতে না পেরে বিভিন্ন বাদ দেওয়া জিনিস দিয়ে গিফট বানিয়ে তাকে দিতাম। তবে কেন জানি এই গিফটগুলো রিমু খুব পছন্দ করতো। রিমুকে দেওয়া আমার সবগুলো গিফট এর মধ্যে রিমুর নাকি সবচেয়ে ভালো লেগেছে আমাদের ব্যক্তিগত বন্ধু দিবসে আমার বানানো একটি উইশিংকার্ড। কার্ডটি আসলেই অনেক সুন্দর হয়েছিল। আমার অসমাপ্ত বন্ধুত্ব গল্পটা পড়ে রিমু আমাকে একটি চিঠি দিয়েছিল। অতঃপর আমার সেই পাঁচ টাকার চিরুনি হয়ে ওঠে অসামান্য। এই অসামান্য হয়ে ওঠার কারণ অসমাপ্ত বন্ধুত্ব উপন্যাসের পাঠকরা ঠিকই বুঝবে। কারণ ওটা ছিল মেঘের প্রিয় গোলাপি রঙের চিরুণী। রিমুও আমাকে গিফট দিতো। এই গল্পের বই, কলম, অথবা শেভ করার টাকা। আমার আমার জীবনে সবচেয়ে বেশি চুরি করেছি রিমুর কলম আর রুমাল। তবে রিমুর কাছ থেকে পাওয়া আমার সবচেয়ে দামি উপহার হল অদৃশ্য। আর সেটা হলো আমার প্রতি তার বিশ্বাস। আমাকে নিয়ে রিমু একবার মন্তব্য করেছিল- পাগল সোহাগ এর পাগলামি কখনো আজব লাগে, কখনো ভালো লাগে। তবে রিমুর এই পাগলের ডাকটার মধ্যে অনেক বেশি ভালোবাসা মাখা থাকতোআমার অদ্ভুত আজগুবি সব কাজ দেখে, কথা শুনে রিমু এই মন্তব্য করেছিলো। ও বলতো ওর গল্প কবিতা পড়তে ভালো লাগে না। তবে আমি নাকি ওকে গল্প পড়া শিখিয়েছি। রিমুর কাছে কারো লেখা ভাল না লাগলেও আমার লেখা সবগুলো নাকি ওর কাছে ভালো লাগতো। তার সাথে বন্ধুত্বের পর আমার সব লেখার প্রথম কপি সে ই পড়তো। সে ছিল আমার তখনকার সব লেখার প্রথম পাঠক। এই যেমন অসমাপ্ত বন্ধুত্ব, চেনা বন্ধু অচেনা পথ, হলুদ বাতির হাসি। আর এখনকার লেখাগুলো আবিদা পড়ে। রিমুকে নিয়ে মেয়েটা বেশ জেলাসি। আমার সব লেখার মধ্যে রিমুর নাকি সবচেয়ে ভাল লেগেছিল অসমাপ্ত বন্ধুত্ব। গল্পটার নাম অবশ্য সে ই ঠিক করে দিয়েছিল। আর গল্পটা পড়ে সে মন্তব্য করেছিলো আমি নাকি খারাপ রাইটার, পাষাণ রাইটার। আমি নাকি আমার লেখা দিয়ে মানুষকে কাঁদায়। অসমাপ্ত গল্পটা পড়ে কান্নার সময়, চোখের পানি মুছতে সে যে টিস্যু ব্যবহার করেছিল সেই টিস্যুটা এখনো আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত আছে। রিমু আমার সাথে রাগ করতে পারতো না ঠিকই, তবে আমি খুব সহজে তাকে রাগিয়ে দিতে পারতাম। আমি যদি রিমুকে কখনও বলতাম আমি যদি মরে যাই! তখন ওর রাগ দেখে কে? তখন ও যা তা বলে আমাকে গালি দিতো। বুঝতাম, আমি মরার কথা বলে রিমু খুব কষ্ট পেতো অথবা কথাটা সে সহ্য করতে পারতো না। তাই সেও মরার কথা বলতো। আমি নিজেও তার মরার বিষয়টা সহ্য করতে পারতাম না। আমার লেখা নিয়ে রিমু আরও একটা মন্তব্য করেছিল। আমি নাকি খুব সাধারন আর কমন বিষয় এবং চরিত্রকে খুব সুন্দরভাবে আমার লেখনী দিয়ে তুলে আনতে পারি। আমার এখনকার জীবনে এমন একটা বন্ধুর হারিয়ে ফেলার গল্পটা বইয়ের অন্য কোন পাতায় লিখবো।

বাকি কলেজ জীবন,

কলেজ জীবনের সেই অল্প সময়ের পরিচিত মুখের ভীড়ে যখন কোনো পুরোনো মুখ ভেবে খুব বেশি মন খারাপ হতো, তখন মুন্সিগঞ্জ থেকে ঢাকা চলে আসতাম মাহমুদ ভাইয়ের কাছে। মাহমুদ ভাই তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলে থাকতেন। পরবর্তী সময়ে ঢাকাতে উনি আমার মাথার উপরে একটা বিশাল ছাদ হিসেবে ছিলেন। বাড়ির বাইরে প্রথম হ্যাপি নিউ ইয়ার ২০১২ সাল। প্রচন্ড খারাপ লাগা থেকে দুই দিনের জন্য ঢাকাতে মাহমুদ ভাইয়ের হলে চলে আসে। থার্টিফার্স্ট নাইটে সারারাত মাহমুদ ভাই আমাকে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পুরান ঢাকা সব ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। ওইদিনই প্রথম চাংখারপোলের বিখ্যাত আফতাবের খিচুড়ি খেয়েছিলাম। কলেজ জীবনের এই দুই বছর যদি বলি সবচেয়ে বেশি কথা হয়েছে কোন স্কুল বন্ধুর সাথে, তাহলে অনায়াসেই নাহিদ পারভেজের এর নামটা বলবো। ক্লাস সিক্সে স্বপন স্যারেররের ইংরেজি কোচিং এ ভুল-বোঝাবুঝি দিয়ে আমাদের বন্ধুত্বের শুরুটা। এখনো পর্যন্ত খুব ভালোভাবেই টিকে আছে। কলেজ জীবনের প্রতিদিনের নানা ঘটনা কিংবা নাহিদের কলেজের কোন ঘটনা থাকতো আমাদের গল্পের বিষয়। অপরিচিত শহরে এসে দিনশেষে নাহিদের সাথে সেই গল্পগুলো আমাকে বেশ মানসিক প্রশান্তি দিতো। কলেজে দুইটা ছোট আপু পেয়েছিলাম শুচি আর শাহানাজ। একদিন টিফিন পিরিয়ডে ওরা দুজন হঠাৎ আমার কাছে এসে বললো আমাকে নাকি তাদের ভালো লেগেছে। তারা আমাকে তাদের ভাই বানাতে চায়। তারা দুজন হোস্টেলে থাকতো। ওদের দুজনের বন্ধুত্ব ছিল বেশ। দুজনের অনেক ঝগড়া, ভুল বুঝাবুঝির বিচার করতে হয়েছে আমাকে। দুজনই যখখন আমার সাথে কথা বলতে আসতো, একজনের কথা আগে শুনলে অন্যজন ফুলে ঢোল হয়ে যেত। বেশ সুন্দর ছিল আমাদের সেই সময়টা। জীবনের যখন বয়স বাড়তে শুরু করে, আস্তে আস্তে সম্পর্কগুলো ফিকে হয়ে যায়। এখন যোগাযোগটা নামমাত্র, তবে সেই সময়টাতে আমি খুব মিস করি। আমি তখন একটা পার্টটাইম চাকরি করতাম। তখনকার সময়ে আমার মাসের যে খরচ তার অর্ধেক দিতেন মা। আর বাকি অর্ধেক আমার চাকরি থেকে আসতো। হঠাৎ এক রেষারেষিতে চাকরিটা চলে যায় আমার। তবে বাসায় জানাইনি। কারণ আমি জানি তখন আমাকে টাকার পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়ার সামর্থ্য ছিলনা আমার মায়ের। খালি খালি উনি আমাকে নিয়ে বেশি চিন্তা করবেন। তখন আমরা দুই ভাইবোন ই বাইরে পড়াশোনা করি। আমি মুন্সীগঞ্জে আর আমার বড় বোন যশোরে। আমি আর আমার বোন দু'জনই গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছি আমার মায়ের ঘাম ঝরানো টাকাতেই। এরই মধ্যে আমি মুন্সীগঞ্জ শিল্পকলা তে নাটক বিভাগে ভর্তি হয়েছিলাম। ওস্তাদ হিসেবে পেয়েছিলাম খ্যাতিমান নাট্যকার, নির্দেশক জনাব জাহাঙ্গীর আলম ঢালী কে। মঞ্চ কিংবা টিভিতে আজ আমার যতটুকুই পদচারণা তার নেপথ্যের কারিগর জনাব জাহাঙ্গীর আলম ঢালী। গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাততে আমার লেখিকা বইটা আমি আমার এই শ্রদ্ধেয় নাট্যগুরুকে উৎসর্গ করেছি। তখনকার সময়ে একে তো চাকরি নেই, তার উপর আবার নাটক শিখছি। এদিকে কলেজের পড়াশোনার চাপ। টাকার অভাবে বুয়াকেও ছুটিতে পাঠিয়েছিলাম। একা একাই ভাত, ডিম ভাজি, আলু ভর্তা কিংবা খিচুড়ি রান্না শিখে গিয়েছিলাম। কত বার যে খাবার পুড়িয়ে নষ্ট করেছি তার হিসাব নেই। সকাল সাতটায় ঘুম থেকে উঠে রান্না করে খেয়ে আটটায় যেতাম কলেজে। কলেজ থেকে দুইটাই ফিরে সকালে রান্না করা ভাত খেয়ে গোসল করে রেডি হয়ে তিনটায় চলে যেতাম দেলোয়ার স্যারের ইংলিশ কোচিং এ। সাড়ে চারটায় পড়া শেষ করে পাঁচটায় শিল্পকলা তে। পাঁচ টা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত মঞ্চ নাটকের রিহার্সেল শেষে বাসায় ফিরতে ফিরতে সাড়ে দশটা। কোনরকম ফ্রেশ হয়ে এঁটো হাড়ি পাতিল ধুয়ে রান্না শেষ করতে করতে বারোটা। আর খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ করে রাত একটায় পড়তে বসতাম। একটা থেকে চারটা পর্যন্ত পড়ে ঘন্টাখানেক অভিনয় প্র্যাকটিস করতাম। তারপর পাঁচটায় ঘুম দিয়ে সাড়ে সাতটায় উঠতাম। এটা ছিল আমার তখনকার বিশাল একটা সময়ের প্রতিদিনের রুটিন। এভাবে অনেক দিন চলেছে। সারাদিনে পুরোটা পথ পায়ের উপর ভর করেই চলতাম। মানিব্যাগে খুচরো টাকা থাকতো, যদি কখনো জুতা ছিড়ে যায়, সেলাই করার জন্য। শোক সংবাদ এর মাইকিং কিংবা ওয়াজ মাহফিলের পোস্টার মেরেও টাকা উপার্জন করেছি। এত এত পরিশ্রম শেষে প্রথম মঞ্চনাটকে আমার বাজিমাত। প্রথম সারির অনেকগুলো জাতীয় দৈনিকে আমার ছবি দিয়ে নাটকের সংবাদ প্রচার করা হলো। কলেজ লাইব্রেরীতে পত্রিকাতে আমার ছবি দেখে অনেক সহপাঠী রীতিমত অবাক। কেউ কেউ আবার তাচ্ছিল্য করে বলেছিল- পত্রিকার এত আকাল পড়েনি যে পত্রিকাতে সোহাগের ছবি ছাপাতে হবে। কয়েক কান ঘুরে এ কথাটা আমার কানেও এসেছিল। পত্রিকাতে আমার বিশাল বড় সে ছবিটা আমার কাছের কিছু বন্ধুও বিশ্বাস করতে পারছিলো না। আর কিছু সহপাঠী জোর করেই বিশ্বাস করতে চাচ্ছিল না। এতে যেন তাদের জাত যাবে যাবে অবস্থা। তবে আমি যখন যেটা করতে চেয়েছি মন দিয়ে করেছি এবং সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে আমি সফলতাও পেয়েছি। আমি বিশ্বাস করি সাধনা, অধ্যবসায় এবং পরিশ্রম একটা মানুষকে সফলতা এনে দিবেই। আজকে এই বয়সে আমার যত অর্জন তা কাকতালীয় নয়। বরং সেগুলো আমার পরিশ্রমের সাধনায় সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত ফল। এর পর তো মঞ্চনাটকে আমাকে আর পেছন ফিরতে হয়নি। যদিও হাতেগোনা যে কয়েকটা প্রোডাকশনের কাজ করেছি। সবগুলোতেই নিজের যোগ্যতা বোঝাতে পেরেছি। আমার প্রতি নির্দেশকের আস্থার সম্মানটা রাখতে পেরেছি। না খাওয়া পেটের সেই কষ্ট আমার লেখার গতি আরো বাড়িয়ে দেয়। তখন খুব কবিতা লিখতাম। আমি খেয়াল করেছি, আমি কষ্টে থাকলে আমার ভেতর সাহিত্য বাসা বাঁধে। আমার লেখালেখি আমার অনেক সহপাঠী কিংবা রুমমেট সহ্য করতে পারতো না একবার ১৮০টা কবিতার একটা ডায়েরী ড্রোয়ার বন্দি করে আমি বাড়িতে গিয়েছিলাম। সেই সুযোগে আমাকে সহ্য করতে না পারা সহপাঠী অনিক আমার রুমমেট রিজভী, স্বপ্ন, তাওহীদের সহযোগিতায় সুনিপুন ভাবে ড্রোয়ারের তালা ভেঙে ডাইরিটা নিয়ে পুড়িয়ে ফেলে। আমি জানতাম কাজটা তারাই করেছে। তবে আমার কাছে কোন প্রমাণ ছিলনা। যদিও প্রমাণ থাকলেও আমার কিছু করার ছিল না। কারণ তাদের তুলনায় আমি ওখানে রিফিউজি। তাদের কাছে হয়তো সেটা নিছক একটা ডায়েরিতে, কিংবা কয়েক কলম লেখা হতে পারে। তবে সেই ১৮০ টা কবিতার কোন কপি আমার কাছে নেই। অনিক সেগুলো পুড়িয়ে ছাই বানিয়ে ফেলেছে। আমি ভেঙে পড়িনি।। বরং সেই জেদ থেকে আরো অনেক নতুন লেখা লিখেছি।

No comments

Powered by Blogger.