Header Ads

সোহাগনামা || পর্ব - ৭

 

Shahriar Sohag, শাহরিয়ার সোহাগ, sohagnama, সোহাগনামা ৭

এসএসসিতে আমার রেজাল্ট ছিল মোটামুটি। জিপিএ ৪.৮৮ নিয়ে এসএসসি শেষ করেছিলাম। ছোটবেলা থেকেই আমার ভেতরে তীব্র ইচ্ছে ছিল অভিনয় করারর। এবং এই ইচ্ছের জন্যই আমি আর এলাকাতে পড়াশোনা করতে চাইনি। সেই সময় থেকেই আমার ইচ্ছে ছিল আমি ঢাকার কোনো কলেজে পড়াশোনা করবো। পাশাপাশি অভিনয়ের সাথে যুক্ত হবো। তখন মুন্সিগঞ্জের ইয়াজউদ্দিন রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজে জনি নামে আমার একটা বন্ধু পড়তো। ওর জন্যই মূলত ঢাকাতে পরীক্ষা না দিয়ে মুন্সীগঞ্জের এই কলেজ টা তে ইন্টার পড়ার জন্য ভর্তি হলাম। এসএসসি পরীক্ষার বন্ধের সময় আমি ওখানে বেড়াতে যাই। নদীর পাড়ের কলেজ সার্বিকভাবে ওখানকার পরিবেশ, সবকিছু আমার খুব ভালো লাগে। সেজন্য আমি ওখানে পড়তে চাই। বাসায় মাকে বলে বহু কষ্টে রাজি করালাম ওখানে পড়ার জন্য। এই কলেজ টা আমার খুব পছন্দের ছিল। একদম নদীর পাড়ে কলেজটা। আমার ক্লাস রুম থেকে নদীর নৌযানগুলো দেখা যেত। যেদিন ক্লাসে পড়া পারতাম না, টিচার দাঁড় করিয়ে রাখতেনন। আর আমি জানালা দিয়ে দূরের লঞ্চ দেখতাম। ইয়াজউদ্দিন রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ প্রাকৃতিক পরিবেশের দিক থেকে অনন্যতবে সার্বিকভাবে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আমার খুব একটা পছন্দ হয়নি বেশ কিছু কারণে। যদি খুব কটাক্ষ করে বলতে হয়, তবে বলবো আমার জীবনের ভুল ডিসিশন গুলোর মধ্যে একটা ছিল এই কলেজে ভর্তি হওয়া। সরাসরি ঢাকা তে ভর্তি হইলে হয়তোবা আমার জন্য আরো ভালো কিছু হতে পারতো। ইয়াজউদ্দিন এ ভর্তির পর মানবিক শাখার ভর্তি রোল হল দুই। আমার ক্লাসে ৪০ জন ছিল। ৪০ জনের ৩৯ জন মুন্সীগঞ্জের ছিল।আর আমি একা ছিলাম মুন্সীগঞ্জের বাইরের কোন একটা জায়গা থেকে পড়তে আসা মানুষ। তখন আমাদের প্রিন্সিপাল ছিলেন মেজর হেলাল স্যার। স্যার ক্লাসে এসে আমাদের সবাইকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন আমরা কে কি হতে চাই। তখন আমি বলেছিলাম আমি লেখক হতে চাই। স্যার আমাকে বললেন আমার ইচ্ছেটা একটু ভিন্ন। আর আমি স্যারকে উত্তর দিলাম সবাই যদি এক রাস্তা দিয়ে হাটে তাহলে তো বাকি রাস্তাগুলোতে ফাঁকা পড়ে থাকবে। অঞ্চল ভেদে আমাদের মানুষগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক ভাষার প্রবণতা থাকবে সেটা সত্যি। আমার ক্লাসের অন্যান্য সব সহপাঠী তাদের মুন্সিগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতো। সেখানে আমি যেভাবেই কথা বলতাম না কেন ওরা আমার কথার ভুল ধরতো এবং সেটা নিয়ে হাসি ঠাট্টা করতো। ওদের অনেক কথা আমি বুঝতাম না। কিন্তু ওরা ঠিকই বুঝতো, কারন তারা সেসব ভাষাতে অভ্যস্ত। আমি কোনো শুদ্ধ ভাষা বললেও তারা সেটা নিয়ে মজা নিত। কারণ হয়তো তারা সে ভাষাতে অভ্যস্ত না। আমি ওদের ভাষার অনেক ভুল পেতাম কিন্তু আমি কিছু বলতাম না। কারণ আমি বলবো কাকে? ওরা তো ওই ভাষাকেই শুদ্ধ মনে করে, ওটাতেই তারা অভ্যস্ত। ওদের কাছে সেটা ভুল মনে হতো না। আর আমার ভাষাটা তাদের কাছে একটা অনিয়মিত ভাষা ছিল। কলেজ জীবনের প্রথম দিকে আমার তেমন কোন বন্ধু ছিল না। আর আমার সেই পুরনো বন্ধু আমার থেকে এক বছরের বড় হওয়াতে ওর সাথে কলেজেও নিয়মিত দেখা হতো না। কারণ আমাদের আলাদা ক্লাস, আলাদা সেকশন, সবকিছুই আলাদা ছিল। আমি আমার মতো করে একটা সার্কেল বানানো শুরু করলাম। বরাবরই আমি খুব কৌতুহলী আর আড্ডা প্রিয় মানুষ। ক্লাসের সবার সাথে টুকটাক পরিচিত হতে শুরু করলাম, তাদের সম্পর্কে জানতে শুরু করলাম। ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল ছিল বর্ষা। ওরে এইম ছিল আইনজীবী হওয়া। ওর সাথে আমার নাট্যকলায় পড়ার ইচ্ছেটা শেয়ার করেছিলাম। বর্ষা পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করেছিল। আমাদের সাথে আরেকটা মেয়ে ছিল, ওর নাম রিমি। রিমির একটা অদ্ভুত অভ্যাস ছিল। আমরা প্রতিদিন খবরের পাতা উল্টে সেদিনের সবচেয়ে আলোচিত কিংবা সেরা খবরটা পড়ার চেষ্টা করি। আর রিমির অভ্যাস হলো সেদিনের রাশিফল দেখা। রাশিফলের প্রতি তার এই আগ্রহর সূত্র ধরেই ওর সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল। সেদিন আমার রাশি ছিল আমি নাকি আমার প্রিয়জনের সান্নিধ্য পাব। ওর আরেকটা শখ ছিল, বাগান করা। রিমি ওদের গ্রামের বাড়ির বর্ণনা দিয়েছিল। আর তাতে ঠাট্টা করে আমি ওদের বাড়িতে বেড়াতে যেতে চেয়েছিলাম। রিমি ঠিকানাও দিয়েছিল। কলেজ জীবন শেষ করার পর একবার গিয়েছিলাম ওদের বাড়িতে, রিমির ছোট বোনের বিয়েতে। কলেজে মোবাইল নেওয়া এলাও ছিল না। রিমি হোস্টেলে থাকতো, বাড়িতে খুব একটা কথা বলতে পারতো না। কলেজ জীবনে আমি অনেকবার রিক্স নিয়ে মোবাইল নিয়ে যেতাম, রিমি আমার ফোন থেকে বাড়িতে ওর মায়ের সাথে কথা বলবে বলে। পরিবার থেকে দূরে এসে পড়তে আসা মেয়েটার চোখে মুখে কেমন জানি একটা পরিবার বিয়োগের শূন্যতা দেখতে পেতাম সব সময়। মা আর ভাই-বোনের কথা ভেবে মন খারাপ করে থাকতো রিমি, আমার ফোন থেকে আন্টির সাথে কথা বলার পর তার চোখে-মুখে সে কি আনন্দ। আমার, রিমির, সুমির আর রুবেলের ইসলাম শিক্ষা পিরিয়ড গ্যাপ ছিল। ওই সময়টা আমরা অন্য কোন রুমে আড্ডা দিতাম। রিমি ফোনে কথা বলতো আর আমি দরজায় পাহারা দিতাম। টানটান উত্তেজনাময় সেই দিনগুলোর কথা এখনো মাঝে মাঝে মনে পড়লে আমি আমার কলেজ জীবনে হারিয়ে যাই। রোমাঞ্চকর এক একটা স্মৃতি, নতুন পরিচিত মানুষ। তাদের মধ্যে যাদেরকে বেশি ভালো লাগতো, ইচ্ছে হতো তাদের সাথে সারাজীবন থেকে যাযই, সারাজীবন যেন তাদের সাথে যোগাযোগ থাকে। আর আজ বাস্তবতার ব্যস্ততায় আষ্টেপৃষ্ঠে থেকে যখন এই লেখা লিখছি, ততদিনে অনেক মানুষই হারিয়ে গেছে কালের স্রোতে। এখন বুঝতে শিখেছি, পথে বহু মানুষের সাথে পরিচয় হবে, তবে পথ শেষে সবাই থাকবে না।

একটা পর্যায়ে গিয়ে আমি এমন ভাবে সবার মন জয় করি যে, সাকিবকে হারিয়ে আমি ক্লাস ক্যাপ্টেন নির্বাচিত হই। ধীরে ধীরে সবার মন জয় করতে শুরু করলাম। ছুটির পর আমি, সুইটি, শশী, মিতুল, সুমি, মিশু ঘুরতে যেতাম। ওদের কাছে মুন্সীগঞ্জ শহর টা বেশ পরিচিত হলেও আমার কাছে তখন সবই নতুন। কলেজের কাছাকাছি একটা সরকারি আবাসিক এরিয়াতে মিশুদের বাসা ছিল। আর শহরের মাঝখানে শশীদের বাড়ি। কলেজ জীবনে ওদের বাড়িতে যাওয়া হয়েছে বেশ কয়েকবার। ওই সময়টাতে মিতুলের বাসাতে গিয়েছি শহরের মধ্যে তানজীল, রোমানের বাসাতেও গিয়েছি। যদিও রোমানের গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার খুব ইচ্ছা ছিল। তবে যাবো যাবো করে সময় মিলিয়ে আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। এরই মধ্যে রোমান সপরিবারে ইতালিতে চলে যায়। এরপর অবশ্য ও যতবার বাড়িতে এসেছে, ততবার ই ওর সাথে দেখা করেছি। ওর বাবা ইটালীতে খুন হয়। পরিবারের পুরো দায়িত্ব রোমানের উপর এসে পড়ে। সবকিছু গুছিয়ে না নিতে পারা ছেলেটার কাঁধে সবাইকে গুছিয়ে দেয়ার দায়িত্ব। জীবনের সংগা কখন কার বদলে যাবে সেটা আল্লাহ ই ভালো বলতে পারবেন।

 রোমান, সবুজ, সাকিব, মিতুল, শশী, সুইটি, সুমি, মনিকা,  এমন হাতে গোনা কয়েকজনের সাথে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। বেশি কাছের ছিল রোমান আর সবুজ। এমনও হয়েছে রোমান অসুস্থ, ওর বাসা তে কেউ নেই, আমি ওর বাসায় গিয়ে রান্না করেছি। রান্নার প্র্যাকটিসটা আমার সেই কলেজ জীবন থেকেই শুরু হয়েছিল। আর একটা পর্যায়ে গিয়ে মুন্সীগঞ্জে আমার সেকেন্ড হোম ছিল সবুজের বাসা। সবুজের বাসা ছিল মুন্সীগঞ্জ শহর থেকে একটু দূরে, মেঘনা নদীর পাড়ে। যখন আমার ভাল লাগতো না, খুব মন খারাপ লাগতো, তখন আমি সবুজের বাড়িতে ঘুরতে যেতাম। সবুজের বাড়িতে আমার অবাধ চলাচল ছিল। একটা পর্যায়ে গিয়ে তো সবুজের বাড়িতে আমি ওদের পরিবারের একজন হয়ে উঠি। এখনো অবাক লাগে আমি খুব অল্প দিনে ওদের বাড়ির এতোটা আপন হয়ে গিয়েছিলাম। আমি আর সবুজ মিলে ওদের বাড়ির অনেক কাজ করতাম। সেটা লাকড়ি সরানো থেকে শুরু করে অন্যান্য অনেক কাজ। সবুজের একটা কুকুরের বাচ্চা ছিল। সবুজ প্রতিদিন ওটাকে শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করাতো। মানে ব্যাপারটা এমন যে, সবুজ নিজে শ্যাম্পু ব্যবহার করুক আর না করুক প্রতিদিন কুকুরের বাচ্চাকে শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করাতেই হবে। যেদিন সবুজের বাড়িতে প্রথম গেলাম সবুজের বোন সিঁড়িতে বসে আছে গোসলের পর শরীরে বসে চুলকাচ্ছে এরকম একটা অবস্থা ওর বোনের নাম সাথী সবুজ আমাকে সাথীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় সাথীকে বলে যে এটা আমার কলেজের ফ্রেন্ড সোহাগ আমি সাথীকে বললাম আপু কেমন আছো সাথী আমার কথার কোন উত্তর দিল না কিছুক্ষণ পর কান থেকে হেডফোনটা খুললে আমাদের জিজ্ঞাসা করল আমরা কিছু বলেছি কিনা আমি আর সমস্ত দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে তো হয়ে দাঁড়িয়ে হাসছি এটা কি হলো আমাদের সাথে। এটা হলো সবুজের বাড়িতে আমার প্রথম যাওয়া স্মৃতি। আর এরপর তো অসংখ্যবার সবুজের বাসাতেই খেয়েছি, থেকেছি, রাতের বেলা গ্রামে ঘুরেছি, মেঘনা নদীতে গোসল করেছি। বড় নদীতে গোসল করার প্রথম স্মৃতি আমার ওখানেই। সাকিব ছিল আমার চোখে আমাদের ক্লাসের অন্যতম একটা কিউট ছেলে। এজন্য ওকে আমার বিশেষ করে ভালো লাগতো। আর তাছাড়া আমার নামের সাথে ওর নামের কিছুটা মিল আছে। সাকিব আর সোহাগ। আমরা সবাই ইংলিশ কোচিং করতাম দেলোয়ার স্যারের কাছে। দেলোয়ার স্যার আর্স আর কমার্সের স্টুডেন্টদেরকে একসাথে কোচিং করাতেন। আমরা তো ছিলাম আর্সে। আর কমার্সের মধ্যে ছিল শিলা আর রিমু। দেলোয়ার স্যারের কোচিং থেকে এই রিমু আর শিলার সাথে একটা ভালো ফ্রেন্ডশিপ তৈরি হয় আমার। একটা পর্যায়ে গিয়ে রিমুর সাথে আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধুত্ব তৈরি হয়। এবং আমাদের বন্ধুত্বটা এতটাই ভাল ছিল যে আমার প্রথম উপন্যাস অসমাপ্ত বন্ধুত্ব আমি রিমুকে উৎসর্গ করেছিলাম। বন্ধুদের নিয়ে লেখা আমার এই উপন্যাসটি প্রথমে নাম ছিল বন্ধুত্বের ইতিকথা। গল্পটা পড়ে রিমু আমাকে পরামর্শ দিয়েছিল গল্পটার নাম পরিবর্তন করে অসমাপ্ত বন্ধুত্ব করার জন্য। আর তারপরে তো অসমাপ্ত বন্ধুত্ব নামেই আমার প্রথম উপন্যাস তুমুল জনপ্রিয়তা পায় যতটা আমি নিজেও কল্পনা করিনি। আমার প্রথম বই আমার পরিবারের কাউকে উৎসর্গ না করে রিমু কে উৎসর্গ করার জন্য অনেকের মধ্যে একটা সন্দেহ তৈরি হয় - রিমু হয়তো আমার প্রেমিকা। কিন্তু আসলে রিমুর সাথে আমার এ ধরনের কোন সম্পর্ক ছিল না। আমাদের দুজনের বন্ধুত্ব ছিল দারুণ।

No comments

Powered by Blogger.