Header Ads

সোহাগনামা || পর্ব - ১৩

Shahriar Sohag, শাহরিয়ার সোহাগ, sohagnama, সোহাগনামা ১৩


২০১৭ সালের অক্টোবর। বিভিন্ন কারণে বাসা বদলানোর সিদ্ধান্ত নিতে হলো আমাকে। তার মধ্যে একটা কারণ ছিল- আমার প্রাণনাশের হুমকি। অজ্ঞাত একটা নাম্বার থেকে আমাকে ম্যাসেজ দেওয়া হল 'আল্লাহু আকবার, রেডি ' লেখালেখির জন্য তখন হরহামেশাই বহু লেখককে জীবন দিতে হয়েছে শুধুমাত্র কোন একটা গোষ্ঠীর সাথে মতের মিল না হওয়াতে। যদিও আমি আমার জানামতে সে ধরনের কোনো লেখা লিখিনি। তবে হুমকি আসাতে আমিও শংকিত হয়ে পড়ি। সবসময় মনে হয় কেউ আমাকে দেখছে, আমার গতিবিধ অনুসরণ করছে। সেই মুহূর্তে আমার থেকে বড় চিন্তা ছিল আমার মা আর প্রেমিকাকে নিয়ে। যেন আমার কিছু হলে তাদেরকে কে দেখবে।

এই শহরে মনের মত বাসা পাওয়া তো দূরের কথা, থাকার জন্য নূন্যতম বাসা পাওয়াটাও যেন ভাগ্যের ব্যাপার। যেটা নির্ভর করে বাসা মালিকের মন মর্জির উপর। সেই সময়টাতে আমি নতুন একজন রুমমেট অথবা মেসে সিট খোঁজাতে দিনরাতের অনেকটা সময় ব্যয় করতাম। আমার বাসা থেকে ১০ মিনিটের হাঁটা পথ দূরত্বে রায়হান থাকতো। রায়হান ছিল আমার একপ্রকার দুঃসম্পর্কের বন্ধু। রাহানের সাথে পরিচয়ের কথা বলতে গেলে অনেকগুলো মানুষের নাম বলতে হবে। আমার স্কুল ফ্রেন্ড ছিল লিপা। লিপার একসময়ের রুমমেট ছিল তমা। তমার বয়ফ্রেন্ড রাব্বির স্কুল ফ্রেন্ড ছিল শাওন। সেই শাওনের খালাতো ভাই হলো রায়হান। সিদ্ধান্ত নিলাম আমি আর রায়হান একসাথে থাকবো। তখন ভালো খারাপ বিচার বিশ্লেষণের থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল থাকার জন্য কোনরকম একটা রুম পাওয়া। নভেম্বর, ২০২০ থেকে জিগাতলা মুন্সিবাড়ী রোডে রাশেদ ভাইয়ের মেসে আমি আর রায়হান দুজন মিলে একটা রুম নিলাম। বদ্ধ একটা রুম, মোবাইলের নেটওয়ার্ক থাকে না। দিনে রাতে সবসময় লাইট জ্বালিয়ে রাখতে হয়। কোন গেস্ট এলাও না। তবু সবচেয়ে বড় সমস্যাটা হলো রাহানের সাথে খুব বেশিদিন আমি মানিয়ে নিয়ে থাকতে পারিনি। লেখালেখির জন্য আমার তখনো রাত জেগে লেখার অভ্যাস ছিল। তবে রায়হানের ঘুমানোর সময় রুমের লাইট তো না , মোবাইলের লাইটেও লেখা যাবে না। ফোনের ডিসপ্লের লাইটেও নাকি তার ঘুম আসে না। ফোনে কথা বললেও বাইরে গিয়ে কথা বলতে হবে। আমি ঘুমিয়ে থাকলেও সে লাইট জ্বালিয়ে পরীক্ষার প্রিপারেশন, ক্লাসের প্রিপারেশন নেবে, ফোনে কথা বলবে, তাতে কোন সমস্যা নেই। দুজনের রুমে 'তার জিনিসপত্র বেশি' এই অজুহাতে রুমের প্রায় পুরোটাই নিজের জিনিসপত্রে দখল করে রেখেছিল সে। এছাড়া যে কোন ব্যাপারে অতিরিক্ত কথা বলা, অহেতুক জ্ঞান দেওয়ার মতো দোষ অথবা গুন ছিল রায়হানের। ছাড় দিয়ে চলার বিন্দুমাত্র মানসিকতা আমি তার মধ্যে দেখি নি। হয়তোবা আমি খুঁজে পাইনি। মেসে থাকার জন্য মাসের একটা নির্দিষ্ট সময়ে আমাদের বাজার করতে হতো। মজার ব্যাপার হলো রায়হানের বাজারের সময় সে শাকসবজি কিনতো। আর আমার বাজারের সময় মাছ মাংস কিনতে বলতো। প্রায় সময়ই আমার থেকে পাঁচ টাকা দশ টাকা বিশ টাকা ধার নিতো। প্রথমদিকে এসবের হিসেব না রাখলেও পরবর্তীতে হিসাব রাখতে বাধ্য হই আমি। যদিও হিসাব রাখার সময় বুঝিনি এই ধারের খাতায় দশ টাকা বিশ টাকা জমে একদিন হাজার টাকা ছাড়িয়ে যাবে। রাহানের সাথে আমার ছয় মাস থাকা হয়। এর বেশি আর সম্ভব হয়নি আমার দ্বারা। মানিয়ে নেওয়ার মানসিকতা কেবল আমার থাকলেই তো হবে না, সাথের মানুষটারও থাকা প্রয়োজন। তাছাড়া রায়হানের সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস ছিল। সিগারেটের গন্ধের সাথে আমি কখনোই মানিয়ে নিতে পারিনি। এমন বিভিন্ন কারণে আমি বাসা বদলাতে বাধ্য হই। ওখানে থাকার শেষদিকে স্কুল বন্ধু ইমরান ঢাকাতে এসেছিলো আমার কাছে।

২০১৮ সালের মার্চে আমার নতুন রুমমেট হয় স্কুল বন্ধু ইমরান। খাতা কলমে ইমরান আমার একব্যাচ সিনিয়র ছিল। এক ক্লাস ড্রপ দেওয়াতেই যত গন্ডোগোল, আমার তখনকার বন্ধুরা আমার থেকে এক বছরের বড় হয়ে যায়। ইমরান তখন রুয়েট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে ঢাকাতে এসেছে চাকরির জন্য। এর আগে আমি যেখানে ছিলাম সেখানে আমার সিটে একমাস রাখি ইমরানকে। সেজন্য তখনকার রুমমেট রায়হানের বাঁকা কথাও হজম করতে হয়েছে। তারপর দুইজন মিলে একসাথে থাকার জন্য বাসা খুঁজতে থাকি। দশ পনেরো দিনের চেষ্টায় ধানমন্ডি পনেরো নাম্বারে আফসার উদ্দীন রোডে বাসা পেয়ে যাই। ছোট্ট একটা রুম, প্রয়োজনের তুলনায় অনেক ছোট একটা ওয়াশরুম আর প্রয়োজনের তুলনায় বেশ বড় একটা রান্নাঘর। রান্নাঘর থেকে রুমে যেতে আনুমানিক ছয়/তিন ফিটের ছোট্ট একটা বাড়তি জায়গা জীবনে প্রথম সেখানে দেখলাম কারো বাসার ভেতরের রং সবুজ হতে পারে। সবুজ রঙের জন্য লাইট দিলেও বাসার ভেতরের অন্ধকার কাটতো না। নতুন সেই বাসা গোছগাছ করতে দুই বন্ধু মিলে অনেক কিছু কেনাকাটাও করলাম। বাসাটা যে আমাদের দুজনের খুব পছন্দ ছিল তেমনটা নয়। প্রয়োজনের তুলনায় ভাড়া বেশি। তবে দুইটা কারণে বাসাটা নেওয়া। ব্যাচেলর জেনেও বাসা মালিক ভাড়া দিয়েছে। আরেকটা হলো এক রুমের ফ্ল্যাট হওয়াতে মেসের ঝুটঝামেলা পোহানোর প্রয়োজন পড়েনি। তবে একটা সমস্যা ছিল, দুইজনের রান্নার জন্য কাজের বুয়া পাওয়া যাচ্ছিল না। আর দুজনেরই বুয়া নিয়ে আলাদা আলাদাভাবে বাজে অভিজ্ঞতার কারণে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম নিজেরাই রান্না করবো। কখনো আমি রান্না করতাম তো কখনো ইমরান। আগে টুকটাক রান্না করা আমি তখন রাঁধুনি হয়ে উঠেছিলাম। আমার বরাবরই আকাশ পছন্দ। পছন্দ জানালার বাইরে উঁকি দিয়ে আকাশ দেখার। তবে এই বাসাতে জানালার বাইরে অন্য বিল্ডিং এর জানালার ছাড়া কিছুই দেখা যেত না। আকাশ, সে তো বহু দূরে। আমরা ছাড়া চার তলাতে আরো যে একটা ফ্ল্যাট ছিল, সেটাতে উঠেছিলো টাঙ্গাইলের পাঁচটা ছেলে। তখন আমাদের বাসাতে ইমরানের ছোট ভাই ইমরোজ ভার্সিটি কোচিং এর জন্য ছিল। ইমরোজকে দিয়ে পাশের ফ্ল্যাটের ছেলেদের ডাকানাম পরিচিত হবার জন্য। আরাফাত, ইমরান, সিয়াম, জিসান, প্রীতম। পরবর্তীতে আমাদের ভ্রাতৃত্ব আরো বেড়েছিল আমরা প্রায়ই রাতে চায়ের পার্টি দিতাম। কখনো কখনো দুই ফ্লাটের সবাই মিলে নিজেরা রান্না করে পিকনিক করতাম। কয়েকজনের জন্মদিন উদযাপনও করা হয়েছিল সেই সময়। একবার সিয়ামের বার্থডেতে আমার বন্ধু ইমরান বলেছিল সে মাংস রান্না করবে। আমরা সেজন্য ওদের বাসার বুয়াকে রান্না করতে নিষেধ করেছিলাম। আর ইমরান সেদিনই রাত করে বাসায় ফিরে দেখে মাংস রান্না হয়নি। এই নিয়ে আমার সাথে ইমরানের কথা কাটাকাটি হয়। একবার ছার পোকার ওষুধ দিয়ে সেই রাতে আমরা ওদের ফ্লাটে ছিলাম। আমি সিয়ামকে দিয়ে বিভিন্ন সময়ে চা বানিয়ে নিয়েছি। নিজে থেকে বানাতে না চাইলে ওকে বরাবরই বিভিন্নভাবে ব্ল্যাকমেইল করতাম। তবে মাঝে মাঝে পাশের ফ্লাটের ইমরানও আমাকে চা বানিয়ে খাওয়াতো। তার অবশ্য কারণ ছিল। ইমরান এক মেয়েকে নিয়ে রিক্সায় হুট তুলে যাবার সময় সাইন্সল্যাবে আমি ওকে দেখে ফেলি। তবে আমি যেন কাউকে এই কথাটা না বলি, সেজন্যই তার চা বানানো। ইমারানের আগ্রহতেই আমার অনেক অপ্রাকাশ্য গল্প শোনাতাম ইমরারকে। সত্যিই আমাদের সেই একসাথে থাকার এক বছরের সময়টা যেন সাজানো গল্পের মত ছিল। তবে সুন্দর সবকিছুই খুব বেশি দিন স্থায়ী হয় না, শুধুমাত্র কল্পনা ছাড়া। ইমরানের অফিস দূরে হওয়াতে একটা সময়ে ইমরান অফিসের কাছে বাসা নিলো, পাশের ফ্ল্যাটের সিয়াম কলেজ বদলে ফিরে গেলো টাঙ্গাইলে। জিসান তারও আগে কলেজ বদলে টাঙ্গাইলে চলে গিয়েছিলো। ইমরানের পরিবার চলে আসলো ঢাকাতে। এভাবে একে একে যে যার মতো আলাদা হয়ে গেলো। আমাদের আড্ডাটা আর হয়ে ওঠে না। কথা হয় খুব কম, দেখা হয় ভুল ভবিষ্যৎ। মাঝে অবশ্য একবার আরাফাতের জন্মদিনের জন্য আমি দুই দিনের জন্য টাঙ্গাইল গিয়েছিলাম। ছিলাম জিসানের বাড়িতে। সবাই চলে যাওয়ার পরও আমি আরো অনেক দিন ওই বাসাতে ছিলাম। করোনার মধ্যেও ২০২০ এর জুন পর্যন্ত ওখানে ছিলাম। এর কয়েক মাস আগে নতুন রুমমেট হয়ে আমার সাথে থাকা শুরু করেছিলো ঢাকা কলেজের সহপাঠী বাশার। ওর বাড়ি যশোর বেনাপোল। বেশ অনেকদিন একা থেকে একাকীত্ব কাজ করায় বাশারের কিছু শর্ত মেনে তাকে নিয়ে নতুন করে থাকা শুরু করি। শর্তগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল দুজনের যা খরচ হবে সেটার অর্ধেকের কম দিবে সে। বন্ধু ভেবে সেটাকে বড় ভাবে দেখিনি আমি। তবে এর কিছুদিন পর থেকে আমার উপরে সব চাপ পড়তে থাকলো। ভাড়া তুলনামূলক কম দিলেও সেই টাকাটাও ঠিক সময়ে দিতো না সে। এমনকি মাসে তার খাওয়ার জন্য বাজারের টাকাটাও বাকি রাখতো মাসের-পর-মাস। তখন লেখালেখি আর ফটোগ্রাফি ছাড়া আমার ইনকাম বলতে তেমন কিছুই নেই। টাকার থেকে আমি বরাবরই সম্পর্ককে গুরুত্ব দিয়েছি। এখন বুঝি সেটা আমার ভুল সিদ্ধান্ত। সম্পর্কের খাতিরে বাশারের এমন আচরণগুলো নিয়ে সামনাসামনি কথা বলিনি। সব সময় নিজেকে এটা বুঝিয়েছি যে সবার মানসিকতা কিংবা পরিস্থিতি সবসময় একই রকম হয় না। তবে কিছু কিছু মানুষের নিচু মানসিকতা যে তার চর্চিত অভ্যাস, সেটা বুঝেছি অনেক পরে। তবে আমি বরাবরই কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। আমার আজকের অবস্থানের পেছনে যাদের ন্যূনতম অবদান তাদেরকে সবার সামনে উপস্থাপনের বিন্দুমাত্র কার্পণ্য বোধ আসেনা আমার মধ্যে। আমার তৃতীয় বই হলুদ বাতির হাসি প্রকাশ করতে প্রকাশনা সংস্থা আলিগড় লাইব্রেরীর সাথে যোগাযোগ করলে তাদের সাথে আমার প্রথম কাজ হিসেবে তারা বইয়ের খরচ বাবদ বাইশ হাজার টাকা চেয়েছিলো। এই বাশার তখন আমাকে ছয় হাজার টাকা ধার দিয়েছিলো। যদিও সেটা পরের মাসেই শোধ করে দিয়েছিলাম। তবে সেই মুহূর্তে টাকাটা আমার দরকার ছিল। ২০২০ এর জুলাইয়ের আমি বাশার আর বাশারের এক বন্ধু মেহেদী তিনজন মিলে ধানমন্ডি ১৯ নম্বর, মাদ্রাসা গলিতে বাসা নিই। বাসাটা আমি পছন্দ করেছিলাম। আমি সেই ফ্লাটটা নিতে চেয়েছিলাম তার পাশের ফ্লাটেই বন্ধু কানন ববউ নিয়ে থাকতো। ওর বাসাতে বেড়াতে এসেই এই বাসাটা পছন্দ হয়ে যায়। বাসার মালিক, ইন্টারনেট আর ময়লা সবখানে আমি ডিল করেছি। তাতেই সমস্যাটা হলো। তারা ঠিক সময়ে ভাড়া না দিলেও নিজ দায়িত্বে আমাকেই সবার পাওনা ঠিক সময়ে পরিশোধ করতে হতো।


ভালো লাগলে শেয়ার করুন 

শাহরিয়ার সোহাগ এর লেখা বইগুলো সম্পর্কে জানতে বা কিনতে ক্লিক করুন

No comments

Powered by Blogger.