সোহাগনামা । পর্ব - ১
সেই সময় সঠিক তারিখ বার আমার মনে নেই। তবে সময়টা দুপুরবেলা।
মাথার উপর সূর্য। জেলা দায়রা আদালতের এজলাস। এখন ওটাকে পুরান কোর্ট বলে সবাই। বহু
পুরনো হলুদ একটা দালান। উচু উচু সিঁড়ি। লোকে লোকারণ্য। কালো গাউন পরা উকিলবাবু আর
বিচারের আশায় আসা বহু বেশের মানুষ। চামড়ার একজোড়া বেল্টওয়ালা স্যান্ডেল, ফুল প্যান্ট আর তুলনামূলক বেশ বড় শার্ট।
ছোটবেলাতে আমার শার্ট প্যান্ট সব মা পছন্দ করে দিত, এমনকি
শার্ট প্যান্টের সাইজও। আমার মা বরাবরই আমার জন্য হাটু পর্যন্ত শার্ট কিনতো সেই
সময়টাতে। একবার এক দোকানদার ঠাট্টা করে বলেছিল ওটা আমার শার্ট নাকি আমার বাবার
শার্ট। কোর্টে যাওয়া মানুষগুলোর হাজারো কারণ থাকে। তবে সে সময় আমি মায়ের সাথে যশোর
বেড়াতে আসতে পারলেই রাজ্যের খুশি হতাম। আর তখন তো বাসেসে আমার ভাড়াও লাগতো না। বলা
চলে আমার যে ভ্রমণ নেশা সেটা হয়তো তখন থেকেই। প্রতি মাসে অন্তত একবার আমার মা
আমাকে নিয়ে যশোর কোর্টে আসতো। বাবা মায়ের সম্পর্কের দূরত্বে বাবা স্বেচ্ছায় আমার
কোনো খরচ দিতো না। তাই আদালতে মামলা করার মাধ্যমেই মা সেই সময় আমার খরচ বাবদ মাসে
পাঁচশ করে টাকা নিতো। মা পাঁচশো টাকা চেয়েছে ব্যাপারটা এমন না। আমার জন্মদাতা আমার
ভরণপোষণ করে না এই মর্মে মা আদালতে মামলা করে। আর আদালতের রায় হয় আমার জন্মদাতা
আমার ভরণপোষণ বাবদ মাসে ৫০০ টাকা করে দেবে। ১০ বছর বয়স হলে সাতশ টাকা করে দেবে ১৮
বছর বয়স পর্যন্ত। যদিও এখনো আমার আদালতের সাথে প্রশ্ন একটা বাচ্চার ভরণপোষণ খরচ
মাসে মাত্র পাঁচ-সাতশ টাকা? আর ১৮ বছর হলেই ছেলে স্বাবলম্বী? তার আর খরচ লাগবে না? যদিও পাঁচ সাতশ টাকার দেবে বলে আমার
জন্মদাতার অযুহাতের শেষ ছিল না। আমাকে টাকা দেয় বলে সে নাকি ঠিক মত নিজের খরচ করকে
পারে না। মানে তারর পুরো বেতনের এই আমাকে দেওয়া পাঁচশ টাকা ছাড়া সে অচল! আর এই পাঁচশ টাকা আনতে যশোর যাওয়া আসা, আমার আবদার মিটিয়ে যশোরে নুরু হোটেলে দুপুরে
খাবার খাওয়া আর এই পাঁচশ টাকা তুলতে একশটাকা ঘুষ দিয়ে মা সর্বসাকুল্যে দেড়শ দুইশ
টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরতো। পরে যখন সাতশ করে টাকা পেতাম তখন ঘুষের টাকা দুইশ তে
পৌঁছেছিল। কোর্টের সামনের কালেট্রোরেট মার্কেট থেকে কখনো আমার জন্য শার্ট প্যান্ট
কিনেই বাড়ি ফিরতাম। তার কিছুদিন পর আমাদেরকে বাদশা ফয়সাল স্কুলের সামনের নতুন
বিল্ডিংটাতে যেকে হতো। আমি সেই বয়সে আদলতপাগা ভালোই চিনে গিয়েছিলাম। আমাদের কোন
রুমে গিয়ে ওয়েট করতে হবে, কাকে
ঘুষ দিতে হবে সেসব যেন আমার ছোট্ট মস্তিষ্কে মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল। এই টাকা আনতে
আমাদের বেশ সকালে রওনা হতে হত। কারণ বিচারক, উকিল
কে কখন আসবেন আমাদের জানা ছিল না। আমাকে শান্ত রাখতে আদালতে ফেরি করে বিক্রি করা
বাদাম, ছোলাভাজা, আরো বিভিন্ন পদের খাবার কিনে দিতো মা। ভাগ্য
ভালো থাকলে দূর থেকে কোনো কোনো দিন আমার জন্মদাতাকে দেখতে পেতাম। মা দূর থেকে
আমাকে দেখাতো - ওই
যে তোর আব্বু। আমরা কোর্টে যাবার আগেই ভদ্রলোক টাকা জমা দিয়ে চলে যেতেন। এটুকু
বোঝার পর তাকে দেখার জন্য আমিও মাকে খুব সকালে রওনা করতে বললাম, এক মাসের বিরতিতে যতি তাকে আবার এক নজর দেখতে
পারি এই আশায়। কখনো ভাগ্যদেবী আমার সহায় থাকতো, কখনো
বা না। তবে ভাগ্যদেবী এক জায়গাতে খুব সহায় ছিল যে আমার মা তখন সরকারি প্রায়মারি
স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। তাতেই আমাদের দুই ভাইবোনকে নিয়ে পেটে ভাতে দিন পার করতেন।
তখন আমি স্কুলেও ভর্তি হইনি। তবে আমার বড় বোন স্কুলে ছিল। আমার বড়বোন আমার সাথে
সাড়ে সাত বছরের বড়। ওর নাম সোনালী। আর আমার নাম সোহাগ। আমরা দুই ভাইবোন। সেই সময়টা
আমার কাজ ছিল মায়ের সাথে স্কুলে যাওয়া। সারাদিনের দুরন্তপনা শেষে মায়ের সাথে
চৌগাছা বাজারে আমাদের ভাড়া করা বাসাতে ফেরা। বেশ কিছু স্কুলে শিক্ষাকতা করলেও আমি জ্ঞানবুদ্ধি
হবার পর থেকে এখন অব্দি তাকে কয়ারপাড়া স্কুলেই দেখেছি। আমার বাবার সাথে আমার তেমন
কোনো স্মৃতি নেই। বড়বেলাতে হাতে গোনা যে কয়েকদিন দেখা হয়েছিল সেটা না হওয়াও ভালো
ছিল। আমি সেটা আমার ভাগ্যের দোষ ই দেবো। ওগুলো আমাকে কষ্ট দেয়, যন্ত্রণা দেয়। এই কষ্ট, যন্ত্রণাগুলো আমাকে যেন নিখাঁদ করেছে, তেমনি দিনে দিতে কমিয়ে দিয়েছে আমার
অনুভূতিগুলো। আমার জন্মদাতা বাবা আমার জন্য কখনো চকলেট কিনে আনেনি। আমি কখনো আমার
বাবার কোলে উঠিনি। তার সাথে আমার কোনো সুন্দর সময় নেই। আমার ছোট্ট আঙুল গুলো
বাবাকে ছুঁয়ে হাটতে শেখেনি।
No comments