মাইকেল মধুসূদন সরকারি কলেজ- শাহরিয়ার সোহাগ
মাইকেল মধুসূদন সরকারি কলেজ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের খুলনা বিভাগের যশোর জেলা শহরের খরকি এলাকায় অবস্থিত একটি স্নাতকোত্তর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ১৯৪১ সালে প্রতিষ্ঠাকালীন সময় এটি যশোর কলেজ নামে পরিচিত ছিলো, যা থেকে বর্তমানে এম.এম. কলেজ নামে পরিচিত হয়। বর্তমানে কলেজটি উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক, সম্মান এবং স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে বিভিন্ন বিষয়ে পাঠ দান করা হয়। বর্তমানে এখানে প্রায় ২৭ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে।
যশোরে উচ্চশিক্ষার জন্য একটি কলেজ স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা বহুদিন থেকেই অনুভূত হয়ে আসছিল এবং সময়ে বৃথা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এবং এটি ১৯৪১ সালে কার্যকর রূপ নেয়। তখন যশোরের শ্রেষ্ঠ সন্তান অধ্যাপক মহিতোষ রায় চৌধুরীর পদক্ষেপে ১৯৪০ সালের আগস্ট মাসে রায় বাহাদুর কেশবলাল চৌধুরী এবং যশোর পৌরসভার সভাপতি সুরেন্দ্রনাথ হালদারের নিজের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন প্রকল্পে এক জরুরি সভার আয়োজন করা হয়। এ সভায় সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন যশোরের তৎকালীন জেলা জজ এস.কে.গুপ্ত । এই অধিবেশনেই স্থির করা হয় যে যশোর এ একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করা দরকার । এই উদ্দেশ্যে ক্ষিতিনাথ ঘোষ এবং মহিতোষ রায় চৌধুরীকে যথাক্রমে সম্পাদক ও যুগ্ন সম্পাদক করে ড.জীবন রতন ধর-কে কোষাধ্যক্ষ করে এবং প্রফুল্ল রায় চৌধুরী (এম, এ, বি-এল) কে সহকারী সম্পাদক করে ৩৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়।
এরপর কার্যনির্বাহী কমিটি স্থানীয় মেডিকেল কর্র্তৃপক্ষের কাছে যান । যেহেতু মেডিকেল করতৃপক্ষের অনুমতি লাভে অকৃতকার্য হয়, ফলে তাঁদের সম্পত্তি অব্যবহৃত অবস্থায় পড়েছিল। এবং পরে ৮টি শর্তের ভিত্তিতে কলেজ পরিচালনা কমিটির সম্পাদক ক্ষিতিনাথ ঘোষ ও সহ-সম্পাদক প্রফুল্ল রায় চৌধুরী একটি দলিলপত্র তৈরি করেন ।
১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এর সময়ে মিত্রবাহিনী কলেজে ঘাঁটি স্থাপন করে । এই সময় কলেজ কর্তৃপক্ষ হাটবাড়ীয়ার জমিদারের কাঁচারী বাড়ীতে (বর্তমান ফায়ার ব্রিগিড অফিস) কলেজ টিকে সরিয়ে নেওয়া হয়। এবং সেখানে ক্লাস শুরু করা হয় । ১৯৪৫ সালে যুদ্ধ শেষ হলে পুনরায় কলেজটিকে পূর্বের স্থানে ফিরিয়ে আনা হয়। আর ঐ সময় কলেজের প্রথম নামটি পরিবর্তন করে যশোরের শ্রেষ্ঠ সন্তান মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের নামে নামকরণ করা হয় সরকারী মাইকেল মধুসূদন কলেজ বা এম. এম. কলেজ,যশোর নামে ।
কলেজ প্রতিষ্টায় কিছু মানুষের অবদান ছিল বিশেষভাবে স্মরণীয় তাঁরা হলেন বিজয় কৃষ্ণরায়, শ্রী নীল রতনধর,বিজয় রায়, খান বাহাদুর লুৎফুর, এড. আব্দুর রউফ. বি. সরকার, নগেন্দ্রনাথ ঘোষ, রনদা প্রসাদ সাহা ও সেই সময়ে কলেজের শিক্ষকবৃন্দ।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর অধিকাংশ হিন্দুসম্প্রদায় এর লোক এই দেশ ত্যাগ করায় কলেজটির সাময়িক সংকট দেখা দেয় । কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই স্থানীয় বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তিবর্গের সহায়তায় সংকট কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয়। ঐ সময় কলেজ পরিচালনার জন্য কিছু ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠন করা হয় কলেজ পরিচালনার নতুন কমিটি। তারা অত্যন্ত সফলতার সাথে কলেজ পরিচালনা করতে সক্ষম হন।
আব্দুর রহিম জোয়াদ্দার ১৯৪৯ সালে কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব গ্রহণ করে কলেজ এর বেশ কিছু উন্নতিসাধন করেন। ১৯৫৬ সালে কলেজে বি.কম (পাস) কোর্সটি চালু করা হয় । ১৯৫৬ সালে কলেজটিতে বি, এস-সি (পাস)কোর্স সহ ভূগোল ও অর্থনীতি, বাংলা বিভাগের সম্মান শ্রেণীর জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক অনুমোদিত হয়। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে ইতিহাস বিভাগ চালু হয় । ১৯৫৯ সালের দিকে অধ্যক্ষ মোঃ আব্দুল হাই ও যশোর জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট, কলেজ পরিচালনা কমিটির সভাপতি এম. রুহুল কুদ্দুস এর প্রচেষ্টায় কলেজটিকে বড়পরিসরে স্থাপনের ব্যবস্থা করা হয়।
কলেজের নতুন জায়গা নির্ধারণ এবং অন্যান্য কিছু জমি দান করেন-- হাজী মোঃ মোরশেদ , মোঃ আব্দুল খায়েরসহ যশোরের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের অবদান রয়েছে । খড়কী এলাকার যারা জমি দিতে আগ্রহী হন তাঁদের মধ্যে খড়কীর মুন্সী নছিম উদ্দীন,মোঃ মহাতাব বিশ্বাস, মোঃ আব্দুল লতিফ, মোহাম্মদ আলী, জবুর আলী জোয়াদ্দার, মোঃ দলিল উদ্দীন, আব্দুস ছোবহা,শরীফ শামছুর রহমান, মোঃ ইমান আলী, প্রমুখ উল্লেখযোগ্য । কলেজ সীমানার ভেতর ছিল তখন পরিত্যক্ত যশোর - ঝিনাইদহ রেল লাইন। এই পরিত্যক্ত রেইল লাইনের তিন বিঘা খাস জমিও কলেজকে দেওয়া হয়েছিল । কলেজের কাজ সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য দুটি কমিটি গঠন করা হয়। একটি প্রকল্প কমিটি এবং অপরটি নির্মাণ কমিটি।
১৯৬০সালের দিকে পরিত্যক্ত রেললাইনের পরিত্যক্ত জমির উপর কলেজের কলাভবন নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয় । ঐ সময় কলেজের নতুন ভবন নির্মাণ এর উন্নয়নে ব্যয় ধরা হয় ১৯ লক্ষ টাকা। নতুন এই কলা ভবনে কলেজের কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৬২ সালে
বর্তমানে কলেজটিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ২৭ হাজার। কলেজের ১৭ টি বিভাগে সেমিনার লাইব্রেরি গড়ে উঠেছে। এই লাইব্রেরীগুলোতে প্রায় ১০০০ এর বেশি গ্রন্থ রয়েছে। কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীতে বইয়ের সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার। খেলার মাঠ,শহীদ মিনার,২ টি পুকুর এবং ৪টি হোস্টেল (ছাত্রদের ২, ছাত্রীদের ২),কলাভবন,পুরাতন বিজ্ঞান ভবন,নতুন বিজ্ঞান ভবন,বাণিজ্য ভবন,অধ্যক্ষের ভবন,শিক্ষকদের রেস্টহাউস,কর্মচারীদের জন্য আবাসিক ভবন, ছাত্র কমনরুম, ছাত্রী কমনরুম, পোস্ট অফিস, শিক্ষক ডরমেটরি ও একটি ক্যান্টিন নিয়ে ২২.১৮ একর জমির উপর এম.এম. কলেজ প্রতিষ্ঠিত।
লেখাঃ শাহরিয়ার সোহাগ
No comments