বঙ্গভঙ্গ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট- শাহরিয়ার সোহাগ
পূর্ববঙ্গ
তথা আমাদের আজকের এই বাংলাদেশের বিবেক আমাদের প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর যাত্রা
শুরু ১৯২১ সালে। ঢাবির এই ৮৭ বছরের ইতিহাস যেমন ঘটনাবহুল তেমনি এর প্রতিষ্ঠা পূর্ব
ঘটনাবলীও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
ভারতের শাসন ভার ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানীর হাত থেকে বৃটিশ রাজের হাতে হস্তান্তর হয় ১৮৫৭ সালের সিপাহী
বিপ্লবের পর থেকে। এ বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল বৃটিশ ভারতের বাংলা থেকে। ভারতীয়
জাতিগুলির মধ্যে বাঙালিরা ছিল সবথেকে সুচিহ্নিত জাতীয় স্বকীয়তার অধিকারী এবং তারা
ভারতের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সূত্রপাত ও বিকাশে উল্লেখ্যযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম
ছিল। বাঙালিরা চিরকাল পরাধীনতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আসছিল। বাংলার বিদেশী শাসন
কখনই সুস্থির হয়নি। ফলে বৃটিশরা এক্ষেত্রে তাদের বিভেদনীতি প্রয়োগের কূটকৌশল গ্রহণ
করে।
দুই বাংলায় বিভেদ সৃষ্টির
উপকরণ বৃটিশদের হাতেই ছিল। এর প্রথমটি ছিল ধর্ম ও দ্বিতীয়টি ছিল পূর্ব বাংলার
আর্থ-সামাজিক অনগ্রসরতা। পূর্ব বাংলার অধিকাংশ মানুষ মুসলমান, এবং পশ্চিম বঙ্গের অধিকাংশ মানুষ হিন্দু। অন্যদিকে বাংলার সব থেকে
উৎপাদনক্ষম অংশ হওয়া স্বত্তেও পূর্ব বাংলা শিল্প-বানিজ্য, শিক্ষা, প্রভৃতিতে পশ্চিম বাংলা
থেকে অনেক পিছিয়েছিল। কলকাতায় বিলাসবহুল জীবপন যাপন করা জমিদার সম্প্রদায়ের বেশির
ভাগের জমিদারীই ছিল পূর্ব বাংলায়। পূর্ব বাংলার প্রধান শহর ঢাকা, পশ্চিম বঙ্গের কলকাতার তুলনায় কিছুই ছিল না। অথচ, ঢাকা শহর যখন মুঘল সম্রাজ্যের বাংলা সুবার রাজধানী কলকাতা তখন নিছক
কতিপয় গ্রামের সমষ্টি।
বৃটিশদের সাথে বিশেষ
সম্পর্কের সুবাদে ও ইংরেজী শিক্ষার বদৌলতে বাংলার হিন্দুরা সমাজজীবনের বিভিন্ন
ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। রাজধানী কলকাতার বিভিন্ন ক্ষেত্রে হিন্দুদের প্রভাব
পোক্ত হয়। এর অন্যতম কারন পশ্চিমবঙ্গ ছিল হিন্দু অধ্যুষিত অন্য দিকে পূর্ব বঙ্গ
ছিল মুসলমান অধ্যুষিত। জনসংখ্যার দিক দিয়ে সমগ্র বাংলায় মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ট
ছিল। সেই অনুপাতে পূর্ব বঙ্গের শিক্ষার অবস্থা ছিল বেহাল। গরীব পূর্ববাংলার জনগনের
উচ্চ শিক্ষার জন্য যেতে হত কলকাতা। পূর্ববঙ্গের সকল কলেজের মঞ্জুরির ক্ষমতা ছিল
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে এবং পরীক্ষার উত্তরপত্র তারাই মূল্যায়ন করত। কলকাতা
বিশ্ববিদালয়ের নম্বর প্রদানে প্রায়ই পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠত।
এদিকে এ সময়ে বাংলা
সাহিত্যে যে জোয়ার আসে, তার মূলে ছিলেন কলকাতা
নিবাসী হিন্দু লেখক সাহিত্যিকরা। যদিও তারা তাদের লেখনিকে সমগ্র বাংলার মানুষের
সমাজ জীবনের প্রতিফলন বলে প্রচার করতেন, কিন্তু তাতে শুধুমাত্র
হিন্দুদের কথাই ফুটে উঠত। বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক একবার তাই
বলেছিলেন, “তৎকালীন সাহিত্য গুলোতে যত গুলো চরিত্র আছে
তাদের নাম পাশাপাশি রেখে পরিসংখ্যান করলেই দেখা যাবে রাম শাম যদু মধুদের সংখ্যা কত
আর রহিম করিমের চরিত্রের সংখ্যা কত। অথচ, বাংলার সংখ্যাগরিষ্ট
মানুষ মুসলমান ছিলেন। অর্থাৎ, বাংলা সাহিত্যেও
পূর্ববাংলা তার স্থান পায় নি।
এহেন পরিস্থিতিতে বৃটিশ
সরকার বঙ্গভঙ্গের ঘোষণা দেয়। তারা তাদের উদ্দেশ্য হিসেবে প্রচার করে “প্রশাসনিক সুবিধা ও পূর্ববঙ্গের আর্থসামাজিক উন্নয়ন”। পিছিয়ে পড়া পূর্ববঙ্গবাসীর কাছে এ ঘোষণা জনপ্রিয় হয়ে উঠে। কারন, নতুন প্রদেশ হলে ঢাকা হবে তার রাজধানী ফলে শুধু মাত্র এই কারনে
পূর্ব বঙ্গ আগের থেকে অনেক বেশি সুবিধা লাভ করবে। অন্যদিকে, কলকাতার এলিট সমাজের প্রায় সকলেই এর বিরুদ্ধে যায়। এই এলিটদের
অধিকাংশই ছিলেন জমিদাররা যাদের জমিদারী ছিল পূর্ববঙ্গে। বঙ্গভঙ্গ হলে পূর্ব বঙ্গকে
আর শোষণ করা সম্ভব হবে না এটা তাদের কাছে পরিস্কার ছিল।
তৎকালীন শিক্ষিত সমাজে
পূর্ব বঙ্গের মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী কেউ ছিল না বললেই চলে। এখানকার কতিপয়
নেতারা শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্দে নিজেদের দলকে সৈণ্যহীন পান। ফলে ১৯১১ সালে
বঙ্গভঙ্গ রদ হয় এবং পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকা আবারো তার রাজধানীর গৌরব হারায়।
ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, টাঙ্গাইলের নবাব নওয়াব
আলী চৌধুরী, এ কে ফজলুল হক প্রমুখ ছিলেন পূর্ব বাংলার প্রধান
নেতা। এরা একপর্যায়ে ভাইসরয়ের সাথে দেখা করেন, ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য। বলাবাহুল্য, এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ট মুসলমান শিক্ষিত হবার
সুযোগ পেত, সেই সাথে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোড়লদের প্রভাব
থেকে পূর্ব বাংলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলো মুক্তি পেত। ১৯১২ সালে লর্ড হার্ডিঞ্জ
ঢাকা সফর করেন এবং ঢাকাতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। ফলে এর পেছনে
লেগে পড়ে সেই পশ্চিমবাংলার লবি। ড. রাশবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল
লর্ড হার্ডিঞ্জের সাথে দেখা করে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধীতা করে
স্মারকলিপি প্রদান করে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
ও রাজনীতিবিদ সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি অত্যন্ত সক্রিয় ভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
স্থাপনের বিরোধীতা করেন। স্যার আশুতোষ মুখার্জির ব্যাপক প্রতিরোধের ফলে এক পর্যায়ে
লর্ড হার্ডিঞ্জ তার সাথে সমঝোতার উদ্যোগ নেয়। অবশেষে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন পাঁচটি নতুন অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি করা
হলে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় লড়াইয়ে ক্ষান্ত দেন। কিন্তু, তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে মঞ্জুরী ক্ষমতা প্রদান করতে দেননি।
বিধায় ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের আগ পর্যন্ত পূর্ব বাংলার সব কলেজকে কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনেই থাকতে হয়েছিল।
এদিকে ১৯১৫ সালে ঢাকার
নবাব সলিমুল্লাহ মারা গেলে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীর নবাব আলি চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রতিষ্ঠার হাল ধরেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দ্যোগে
ভাটা পড়ে। ১৯১৭ সালে লন্ডনে ইম্পেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে নওয়াব আলি চৌধুরী
অবিলম্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আহ্ববান জানান। অবশেষে, সকল প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার
যাত্রা শুরু করে।
পশ্চিম বঙ্গ লবি এরপরও
ক্ষান্ত দেয় না। পূর্ব বঙের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষ মুসলমান হওয়ায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই ইসলামের ইতিহাস শিক্ষার
প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া হয়। ফলে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের
ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বলত "মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়" অথবা
"মক্কা অব দি ইস্ট"। অথচ, প্রতিষ্ঠার প্রথমে
দীর্ঘকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দু ছাত্ররাই ছিল সংখ্যা গরিষ্ট। তাছাড়া, অদ্ভুত হলেও সত্য হল এই যে এর আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা
ওরিয়েন্টাল ল্যাঙ্গুয়েজেস এর অধীনে পড়ানো হত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রথম আলাদা
বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগ খোলা হয়। কলকাতা কেন্দ্রিক এহেন অপমানকর প্রোপাগান্ডার
বিরূদ্ধে লড়াইয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ঢাল হয়ে দাড়ান, এর কিছু প্রতিতযশা হিন্দু শিক্ষক। আইনজ্ঞ অধ্যাপক নরেশচন্দ্র
সেনগুপ্ত, রসায়নবিদ জ্ঞান ঘোষ, বিখ্যাত ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদার, পদার্থ বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু এবং আরো অনেক হিন্দু শিক্ষক
সাম্প্রদায়িক চিন্তা ভাবনার উর্ধে থেকে আমাদের প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে তার
প্রথম দিকে কণ্টকাকির্ন পথ অতিক্রমে সাহায্য করেন। অধ্যাপক নরেশচন্দ্র মজুমদার বিশ্ববিদ্যালয়ের
আইনের কাঠামো তৈরি করে দেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পূর্ব থেকেই তিনি ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের দিকে জোর দেন। এই সব শ্রেদ্ধেয় শিক্ষকরা
ঢাকার হিন্দু সমাজের কাছ থেকেও বিরোধের সম্মুক্ষিণ হন। প্রথম দিকে ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন ভাতা ছিল অনেক বেশি এবং তারা রমনা এলাকায়
বঙ্গভঙ্গের সময় গড়ে উঠা বড় বড় সরকারী ভবনে থাকতেন। ঢাকার ঈর্ষান্বিত হিন্দু সমাজ
এটা সহ্য করতে অপরাগ ছিলেন।
কলকাতা নিবাসী বুর্জোয়া
হিন্দু সম্প্রাদায়ের গোড়ামী বদৌলতেই,এক পর্যায়ে বৃটিশদের
কূটকৌশলের জয় হয় এবং মনস্তাত্বিকভাবেই দুই বাংলা পৃথক হয়ে পড়ে। প্রাদেশিক সিমান্ত
রেখার আর কোন প্রয়োজন ছিল না। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পেছনে পশ্চিমবাংলার এলিটরা যে
সব যুক্তি দেখিয়েছিলেন সেগুলো যে নিছক রাজনৈতিক ছিল তা পরিস্কার হয়ে উঠে ১৯৪৭ এর
দেশবিভাগের সময়। আবুল হাশিম, শরৎচন্দ্র বসু প্রমুখ
নেতারা ভারত-পাকিস্তানের সাথে না গিয়ে স্বাধীন বাংলা দেশের
যে প্রস্তাব রেখেছিলেন তা বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি, পশ্চিমবঙ্গের নেতাদের অসহযোগীতার কারনে। মূলত, ব্যাপারটা ছিল এই রকম, ১৯০৫ সালে পশ্চিমবাংলার
হিন্দু মধ্যবিত্তের প্রতিযোগীতায় আসতে পারে এমন কোন মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় পূর্ব
বাংলায় ছিল না। দুই বাংলা এক থাকলে বিনা প্রতিরোধে পূর্ব বাংলাকে শোষণ করা সম্ভব
ছিল। কিন্তু ১৯৪৭ এ পরিস্থিতি ছিল উলটা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে পূর্ব
বাংলায় গড়ে উঠেছিল একটা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী, যারা পশ্চিমবঙ্গের মধ্যবিত্ত শ্রেনীর নিকট গন্য হয়েছিল প্রতিপক্ষ
স্বরুপ। এই শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সামনে দাড়াবার সাহসের অভাবে কলকাতার বাবুরা
আলাদা থাকাকেই শ্রেয় মনে করলেন।
১৯০৫ এ যদি পূর্ববাংলা
ও আসাম প্রদেশ গঠিত হত তাতে ক্ষতি কি হত? ভারতে কত প্রদেশ রয়েছে, তাই বলে কি প্রদেশগুলো এক ভারতের অংশ নেই? সম্পূর্ণ বাংলাকেই যদি তারা এক চোখে দেখে থাকবেন, তবে কেন পশ্চিম বঙ্গের থেকে পূর্ব বাংলা এত পিছিয়ে ছিল? উত্তর একটাই, পশ্চিম আমাদের পূর্ব বাংলাকে শোষণ করেছে। সে
পশ্চিমের অংশ যেমন মুঘল, বৃটিশ, পাকিস্তান তেমনি
পশ্চিমবঙ্গ। এই পশ্চিমাদের
অসহযোগীতায় আমরা পূর্ববাংলাবাসী যদিও পাকিস্তানের সাথে গিয়েছিলাম, তবুও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের মাঝে স্বাধীনতাবোধ, দেশমাতৃকার প্রতি প্রেম ও বাংলাভাষা কেন্দ্রিক
জাতীয়তাবাদের যে চেতনার জন্ম দেয় তারই বদৌলতে আমরা জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছি
অসম্পূর্ন বঙ্গভঙ্গের সম্পূর্ণ রুপ , আমাদের বাংলাদেশ।
(বিদ্র: লেখাটিতে যে সব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে তার সব পাওয়া যাবে
নিচের বইগুলোত –
১. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশি বছর – অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম
২. যদ্যপি আমার গুরু – আহমদ ছফা
৩. বঙ্গভঙ্গ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি – বদরুদ্দীন উমর)
No comments